ভাতার টাকা গ্রাম পুলিশের স্ত্রী ও সন্তানের মুঠোফোনে

দুই শতাধিক মানুষকে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, গর্ভবতী, বিধবাদের বিভিন্ন ভাতা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হারুন ও উজ্জ্বল।

মানিকগঞ্জ জেলার মানচিত্র

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দিঘী ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশের দুই সদস্যের বিরুদ্ধে বয়স্ক ভাতার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভাতাভোগী বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার তথ্য অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করার সময় মুঠোফোন নম্বর পরিবর্তন করে ওই দুই গ্রাম পুলিশ তাঁদের স্ত্রী ও ছেলের নামে নিবন্ধন করা সিমকার্ড ব্যবহার করে ভাতার টাকা আত্মসাৎ করছেন।

এ বিষয়ে ৭ মার্চ ইউনিয়নের ডাউটিয়া গ্রামের বাসিন্দা হোসেন আলী (৮৫) এবং তাঁর স্ত্রী সাহেরা বেগম (৭৫) দুই গ্রাম পুলিশ সদস্য মো. হারুন ও উজ্জ্বল হোসেনের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেওয়ার কথা বলে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে খরচের দোহাই দিয়ে হোসেন আলী ও সাহেরা বেগম দম্পতির কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা এবং তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ছবি ও মুঠোফোন নম্বর নেন হারুন ও উজ্জ্বল। এরপর প্রায় এক বছর পরও কোনো টাকা পাননি ওই দম্পতি।

শারীরিক সক্ষমতা না থাকায় প্রতিবেশীদের সাহায্য-সহায়তায় কোনোরকম চলছি। এই পরিস্থিতিতেও গ্রাম পুলিশ হারুন ও উজ্জ্বল প্রতারণা করে আমাদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
হোসেন আলী, ভুক্তভোগী

পরে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন, ভাতাভোগীদের মুঠোফোন নম্বরের পরিবর্তে গ্রাম পুলিশ উজ্জ্বলের স্ত্রীর মুঠোফোন নম্বর এবং হারুনের ছেলে জুয়েল মিয়ার মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। ওই নম্বরগুলোতে নিয়মিত টাকা পাঠানো হয়েছে।

হোসেন আলী বলেন, ‘শারীরিক সক্ষমতা না থাকায় প্রতিবেশীদের সাহায্য-সহায়তায় কোনোরকম চলছি। এই পরিস্থিতিতেও গ্রাম পুলিশ হারুন ও উজ্জ্বল প্রতারণা করে আমাদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’

ইউএনও জ্যোতিশ্বর পাল বলেন, দুজন গ্রাম পুলিশের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর বাইরে এলাকায় অস্ত্রোপচার করা প্রসূতি নারী এবং সুস্থ মানুষকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়ার নামে গ্রাম পুলিশ সদস্য হারুন ও উজ্জ্বল সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে এলাকায় দাপট দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার তথ্যও পাওয়া গেছে।

ডাউটিয়া সাহাপাড়া গ্রামের সরস্বতী সাহা বলেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর বড় মেয়ে ঐশি সাহা ও ছোট মেয়ে শশী সাহা সন্তান প্রসব করেন। অস্ত্রপচারের সময় শরীরের কাটা দাগকে প্রতিবন্ধিতা দেখিয়ে প্রায় এক বছর আগে ভাতার কার্ড করে দেওয়ার প্রলোভন দেখান গ্রাম পুলিশের সদস্য হারুন। এ জন্য দুই দফায় ৭ হাজার ৫০০ টাকা নেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্ড সরস্বতীর মেয়েরা পাননি। টাকা ফেরত চাইলে হারুন তাঁকে ভয়ভীতি দেখান।

প্রায় তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় ডাউটিয়া গ্রামের রিকশাচালক মোখলেছুর রহমানের (৫০) ডান পা ভেঙে যায়। চিকিৎসার পর এখন কিছুটা সুস্থ তিনি। মোখলেছুর রহমান বলেন, প্রায় দুই বছর আগে তাঁকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়ার জন্য ৮ হাজার টাকা নেন হারুন ও উজ্জ্বল। তবে এখন পর্যন্ত তিনি কোনো ভাতার টাকা পাননি।

সম্প্রতি সরেজমিনে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিঘী ইউনিয়নের ডাউটিয়া, ডাউটিয়া সাহাপাড়াসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের দুই শতাধিক মানুষকে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, গর্ভবতী, বিধবাদের বিভিন্ন ভাতা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হারুন ও উজ্জ্বল। টাকা ফেরত চাইলে তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হয়।

হারুনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলে সংযোগ বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর ছেলে জুয়েল মিয়া নিজের মুঠোফোনে বিকাশে টাকা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘কিছু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম। পরে টাকা ফেরত দিয়েছি। আর ভাতাভোগীর মোবাইল নাম্বারের জায়গায় ভুলে আমার স্ত্রীর নম্বর দেওয়া হয়েছিল।’

সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রুশিয়া আক্তার বলেন, তিনি এই কর্মস্থলে যোগদানের আগে কিছু ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ড বিতরণ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে তদন্ত করে ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ড চিহ্নিত করে সেগুলো বাতিল করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

অভিযোগের বিষয়ে গত রোববার ওই দুই গ্রাম পুলিশ সদস্যকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান দিঘী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আখতার উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে।