ঠাকুরগাঁও
হারাবে না নদী ও তার পানি
পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ দেশের ৩২ জেলার ১৬৫টি নদীর পানির নমুনা রাখা হয়েছে এসব বোতলে। বোতলগুলোর গায়ে নদীর নাম লেখা। সঙ্গে আছে যিনি পানি সংগ্রহ করেছেন, তাঁর নামও।
দূষিত বায়ুর শহর চীনের বেইজিংয়ে বোতলে ভরে বিশুদ্ধ বায়ু বেচাকেনা হতো একসময়। এবার বায়ু নয়, বোতলে ভরে রাখা হয়েছে নদী ও সাগরের পানি। তবে বিক্রির জন্য নয়। শুধু প্রদর্শনীর জন্য সংগ্রহে রাখা হয়েছে দেশ–বিদেশের নদী, সাগর, মহাসাগরের পানি। দেশেই বিচিত্র এমন সংগ্রহশালা রয়েছে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে।
কাঠের তাকে থরে থরে সাজানো কাচের বোতল। সব কটিই নদীর পানিতে ভরা। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, ইছামতীসহ দেশের ৩২ জেলার ১৬৫টি নদীর পানির নমুনা রাখা হয়েছে এসব বোতলে। বোতলগুলোর গায়ে নদীর নাম লেখা। সঙ্গে আছে যিনি পানি সংগ্রহ করেছেন, তাঁর নামও।
শুধু কি দেশ! আছে দেশের বাইরের লন্ডনের টেমস নদী, জার্মানির দানিয়ুব, আন্দামান সাগর, লোহিত সাগর, মর্মর সাগর, আরব সাগর, ভারত সাগর ও উত্তর সাগরের পানির নমুনাও। রয়েছে কয়েকটি সাগর ও মহাসাগরের বালুও।
নানা কারণে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের অনেক নদী। একাদশ শতাব্দীতে দেশে প্রায় দেড় হাজার নদী ছিল। হারিয়ে যেতে যেতে ষাটের দশকে সেই নদীর সংখ্যা ৭৫০–এ এসে দাঁড়ায়। আর এখন এ সংখ্যা কমে হয়েছে ২৩০। গত ৫০ বছরেই হারিয়ে গেছে দেশের ৫২০টি নদী। বাকি নদীও এক এক করে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো হারিয়ে যাওয়া সেই নদীর নামটিও অজানা থেকে যাবে। নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের নদী ও নদীভিত্তিক জনজীবনের ইতিহাস তুলে ধরতেই এই আয়োজন, জানালেন নদী গ্যালারির উদ্যোক্তারা।
জাদুঘরের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিয়ে বেসরকারি সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পূর্ব আকচায় গড়ে তুলেছে ‘লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘর’ নামে ভিন্নধর্মী এক সংগ্রহশালা।
‘তৃণমূল লোকজ গ্যালারি’ দিয়ে এই সংগ্রহশালার যাত্রা শুরু হলেও এতে একে একে ঠাঁই পেয়েছে দেশি–বিদেশি নানা বাদ্যযন্ত্র। রয়েছে ‘আঞ্চলিক ভাষা গ্যালারি’। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে স্থাপন করা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি’। তবে সংগ্রহশালার সবচেয়ে আকর্ষণ হচ্ছে ‘নদী গ্যালারি’।
যেভাবে শুরু
নদী গ্যালারির উদ্যোক্তারা জানালেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থীকে যদি ২০টি নদীর নাম লিখতে বলা হয়, তাহলে সে ভাবনায় পড়ে যাবে। বাংলাদেশ নদীভিত্তিক বদ্বীপ হলেও সেটার তথ্য–উপাত্ত সেভাবে নেই। আগামী প্রজন্মকে হারিয়ে যাওয়া নদীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নদী বিষয়ে সচেতন করতেই নদী গ্যালারি স্থাপনের উদ্যোগ নেন ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। সেখানে নিজের সংস্থার কর্মীদের হাত দিয়ে নদীর পানি সংরক্ষণ শুরু হলেও এ উদ্যোগে এগিয়ে আসেন অনেকেই। ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় নদী গ্যালারিটি।
সংগ্রহশালার উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি আধপাকা ভবন তৈরি করে স্থাপন করা হয়েছে নদী গ্যালারিটি। ঘরে কাঠের র্যাকে কাচের বোতলে রাখা হয়েছে পানির নমুনা। প্রতিদিনই সেখানে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নদীর পানি।
নদীকেন্দ্রিক নানা উপকরণ
দেশে নদীর সংখ্যা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী–তীরবর্তী জনপদেও এসেছে সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের পরিবর্তন। নানা উপকরণ ও ছবির মধ্য দিয়ে তা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাছ ধরার চাঁই, খালই, জাল। আবার কোন নদী কোন এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে, একটি মানচিত্রে তা দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি বাজছে নদীভিত্তিক গান। দেয়াল সাঁটানো রয়েছে নদীর দৈর্ঘ্য ও প্রবাহিত এলাকা, নদীভিত্তিক নানা প্রশ্নোত্তর। ১৭৮১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের বন্যাসংক্রান্ত ইতিহাস, নদীকেন্দ্রিক জীবনযাপন, নৌকা, সংস্কৃতি, উৎসব ও দেশীয় মাছের ছবি। গ্যালারির সামনেই রাখা হয়েছে একটি নৌকা।
নতুন ধারণা ও দর্শনার্থীদের কথা
নদী গ্যালারিতে আরও দুটি ধারণা যুক্ত হচ্ছে বলে জানালেন উদ্যোক্তারা। নদীর পানির পাশাপাশি সেখানে চাপিলা, বইচা, চাঁদা, বাইলা, মেনি, ভেদা, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলাসহ দেশি প্রজাতির মাছ প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পানসি, কোষা, ডিঙি, সাম্পানসহ ৩০০ নৌকার নমুনা বানিয়ে তা এই গ্যালারিতে রাখার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
নদী গ্যালারির প্রতি এলাকার মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। সম্প্রতি সংগ্রহশালায় গিয়ে পাওয়া গেল একদল শিক্ষার্থীকে। তারা স্থানীয় কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সে সময় কথা হয় সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আফসারের সঙ্গে। আফসার বলে, ‘বইয়ে পড়েছি, আমাদের দেশে কয়েক শ নদী আছে। সেসব নদীর অনেকগুলোতেই এখন পানি থাকে না। এখানে এসে সেসব নদীর পানি দেখতে পেলাম।’
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সোহরাব হোসেন বললেন, ‘এখানে এসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা নদীর নাম জানলাম। নদী নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজে এই গ্যালারি বেশ দরকারি।’
সংগ্রহশালা ঘুরতে আসা রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সইদুল হক বলেন, এটি একটি সৃজনশীল উদ্যোগ।