মায়ের ৫০০ টাকায় জাহিদের ব্যবসা শুরু, এখন একাধিক খামার ও পুকুরের মালিক
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের ভীমনগর গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা জাহিদ হাসান ওরফে তপু (৩৫)। অভাবের কারণে তিনি বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি। পরে মায়ের কাছ থেকে মাত্র ৫০০ টাকা নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। তাঁর এখন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ছাগল ও মাছের খামার রয়েছে। তিনি এখন সফল ব্যবসায়ী ও তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে এলাকায় পরিচিত।
বালিয়াকান্দির ভীমনগর গ্রামের সামসুর রহমান ও আবেদা সুলতানা দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান জাহিদ হাসান।
জাহিদের যেভাবে উত্থান
জাহিদের ছোট বোন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় অনেক টাকা খরচ হয়। বোনের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ মেটাতে নিঃস্ব হয়ে যায় তাঁর পরিবার। তবু ছোট বোনটিকেও বাঁচাতে পারেনি তাঁর পরিবার। দারিদ্র্যের কারণে বালিয়াকান্দি আলিয়া মাদ্রাসায় ২০১৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বেকার বসে না থেকে ২০০৮ সালে ব্যবসার জন্য নিজেদের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে ছোট দোকান করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাবার বাধায় মন খারাপ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে মায়ের থেকে ব্যবসার জন্য ৫০০ টাকা চেয়ে নেন। তবে স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে ভাগে ব্যবসা করতে গিয়ে তাঁর লোকসান হয়। ভাগের টাকা ফেরত নিয়ে সেটাও খরচ করে ফেলেন। মায়ের কাছে আবারও ৫০০ টাকা নিয়ে স্থানীয় সোনার মোড় বাজারে শুরু করেন বাদাম-চানাচুর বিক্রি।
জাহিদ হাসান বলেন, ২০১৪ সালে শবে বরাতে মুরগির ব্যবসার পরিকল্পনা করেন। পরিচিত খামার থেকে মুরগি এনে শবে বরাতে বিক্রি করে প্রথম দিন ১৬ হাজার এবং দ্বিতীয় দিন ১৭ হাজার টাকা লাভ করেন। দুই দিনে প্রায় ৩৩ হাজার টাকা তাঁর পুঁজি হয়ে যায়। স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০০টি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা নিয়ে সোনার মোড় এলাকায় একটি শেড দোকান মাসিক ৮০০ টাকায় ভাড়ায় নিয়ে পালন শুরু করেন। ৩২ দিন পর ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করে ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয়। ২০১৫-১৬ সালে সোনার মোড়ে আরও পাঁচটি ব্রয়লার মুরগির শেড করেন। পাশাপাশি দোকান ভাড়া নিয়ে মুরগি বিক্রি ও মুদিখানা শুরু করেন।
জাহিদ হাসান বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি বালিয়াকান্দি বাজার থেকে ৯ হাজার ২০০ টাকায় হরিয়ানা জাতের দুটি ছাগল কেনেন। বাড়ির কাছে বাৎসরিক ১২ হাজার টাকায় ৭২ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়ে আমের বাগান ও ছাগলের খামার করেন। কয়েক বছরে খামারে ৩৫টির মতো বিভিন্ন প্রজাতির ছাগল লালনপালন করেন। গত বছর ২০টি ছাগল সাড়ে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে বাড়ির কাছে প্রায় ১০ বিঘা জমি ইজারা নেন। বর্তমানে খামারে ১৫টির মতো ছাগল রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ছাগলই বাচ্চা দেবে। বাড়ির পাশে ১০০ শতাংশ নিজস্ব জমিতে ধানের আবাদ করেছেন। এর মধ্যে কৃষি বিভাগের পরামর্শে এক বিঘা জমিতে ব্রি-৯০ জাতের হাইব্রিড ধানের প্রদর্শনী প্লট করেছেন। ১০ শতাংশ জমিতে শীতের আগাম হাইব্রিড জাতের টমেটো, করলা, লাউয়ের আবাদ করেছেন। এ ছাড়া বাড়ির পাশে ৮৪ শতাংশ জমি নিয়ে একটি নিজস্ব পুকুর রয়েছে। ছাগল লালন ও পুকুরের মাছ চাষেও তিনি সফল হয়েছেন।
বালিয়াকান্দিতে ফুলের দোকান না থাকায় ২০১৮ সালে বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের সামনে দোকান ভাড়া নিয়ে ‘আরবী কসমেটিকস অ্যান্ড ফুলঘর’ নাম দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। যশোরের গদখালি থেকে ফুল এনে বিক্রি করে চালান খাটিয়ে দেখেন লাভ বেশি হয় না। এ ছাড়া গদখালি থেকে ফুল এনে খরিদ্দারদের ঠিকমতো ফুল পৌঁছে দিতে না পারা এবং নষ্ট হওয়ায় নিজেই ফুল চাষের উদ্যোগ নেন।
২০১৯ সালে যুব উন্নয়ন থেকে ফুলের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এলাকায় প্রথম নিজস্ব ১০ শতাংশ জমিতে ফুল চাষ করেন। পরে পরিধি আরও বাড়িয়ে বাৎসরিক ৪৫ হাজার টাকায় ১০০ শতাংশ জমি বন্ধক নেন। তাঁর বাগানে চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা বাসন্তী, গাঁদা লাল, গোলাপ, রজনী ভোট্টা, রজনীসহ কয়েক প্রকার ফুল রয়েছে। এখন বালিয়াকান্দি ছেড়ে রাজবাড়ী জেলা, এমনকি ফরিদপুরেও তিনি ফুল সাপ্লাই দিচ্ছেন।
জাহিদ হাসান বলেন, ‘মায়ের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। পারব না বলে বাবা বারণ করেছিল। কিন্তু মা বলেছিল, “আমার দোয়া আছে, ও পারবে।” মা-বাবার দোয়ায় ১০ বছরে বালিয়াকান্দিতে তিনটি নিজস্ব দোকান এবং ফরিদপুরের মধুখালীতে একটি বড় দোকান করেছি। বাড়িতে ছাগল, মাছের খামারের পাশাপাশি প্রায় ১৮ বিঘা জমিতে ফুল, ধান ও সবজির আবাদ করেছি। প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ করে পাকা দেয়াল করে ঘর করেছি। বর্তমানে ৮–১০ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিয়মিত কাজ করছে। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।’
জাহিদ হাসান বলেন, ‘ভবিষ্যতে আরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে দেশি মোরগ-মুরগি তেমন একটা পাওয়া যায় না। মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণ করতে দেশি মোরগ-মুরগির খামার করার পরিকল্পনা রয়েছে। সুযোগ পেলে অসহায় মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য ডেইরি খামার করার পরিকল্পনাও রয়েছে। আমাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের যদি সরকার আর্থিক জোগান দেয় তাহলে বেকার সমস্যা অনেকটা দূর হবে।’
মা আবেদা সুলতানা বলেন, ‘আমার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে জাহিদ দ্বিতীয়। টাকার অভাবে পড়াশোনা বেশি দূর করতে পারেনি। একদিন আমার কাছে জাহিদ ব্যবসার জন্য ৫০০ টাকা নেয়। প্রথমবার লোকসান হলে আবারও ৫০০ টাকা দিই। সন্তান ও পরিবারের সবার জন্য দোয়া করি। বর্তমানে সবাই অনেক ভালো আছি। পরিশ্রম আর সততা থাকলে তার উন্নতি হবেই।’
কর্মকর্তা যা বললেন
জাহিদ হাসানের সফলতার গল্প শুনে ২ নভেম্বর দুপুরে তাঁর ধান ও সবজিখেত পরিদর্শন করেন রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম। এ সময় তাঁর সঙ্গে বালিয়াকান্দি উপজেলাসহ জেলার অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মাঠ পরিদর্শনের পর শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহিদ হাসান একজন পরিশ্রমী, সফল ও তরুণ উদ্যমী উদ্যোক্তা। আমরা এ ধরনের তরুণ উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে চাই। যাঁরা কৃষিক্ষেত্রে ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে একেকজন তারকা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করবেন। আমরা এ ধরনের তরুণদের নানা পরামর্শ দিচ্ছি, যাতে তাঁরা দেশের কৃষিক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন।’
শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বর্তমানে নতুন উদ্ভাবিত ব্রি ধান-৯০ জাতের চিকন ধান কৃষি বিভাগের উদ্যোগে জাহিদের এক বিঘা জমির মাধ্যমে প্রথম প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছে। তাঁর খেত থেকে ১০ মণের বেশি ধান উৎপাদিত হবে। এই ধান অনেক চিকন ও দামি। আগামী এক সপ্তাহ পর এই ধান তোলা যাবে। স্বাভাবিক ধানের চেয়ে এই ধান দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। জাহিদের মাধ্যমে বালিয়াকান্দি থেকে রাজবাড়ীতে এই ধান ছড়িয়ে দিতে চাই।’