ভাসমান তরিতে আনন্দপাঠ 

জামালগঞ্জে তরিগুলো আসে ৬ অক্টোবর। এখানে তরিগুলো থাকে গত রোববার পর্যন্ত। পরে তরিগুলো কিশোরগঞ্জে চলে যায়। 

সুরমা নদীর তীরে বিজ্ঞান, গণিত ও মূল্যবোধের শিক্ষাতরি। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা সদরের ঘাটে
ছবি: প্রথম আলো

নদীর ঘাটে পানিতে পাশাপাশি ভাসছিল তিনটি সুসজ্জিত স্টিলের বড় নৌকা। প্রতিটি নৌকার পরিচিতি লেখা—‘বিজ্ঞানতরী’, ‘গণিততরী’ ও ‘মূল্যবোধতরী’। নানা নকশায় রং করা এসব তরির বাইরের সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করার মতো। ভেতরে দল বেঁধে আনন্দময় পরিবেশে নানা উপকরণ ব্যবহার করে হাতে-কলমে বিজ্ঞান, গণিত ও মূল্যবোধের পাঠ নেয় শিক্ষার্থীরা। 

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা সদরের সুরমা নদীর ঘাটে রাখা ছিল ওই তিন ‘শিক্ষাতরি’। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তিতে তাদের শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় এই বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা থেকে এই শিক্ষাতরিগুলো যাত্রা শুরু করেছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে দেশের ১৩টি জেলা ঘুরবে। জামালগঞ্জে তরিগুলো আসে ৬ অক্টোবর। এখানে তরিগুলো থাকে গত রোববার পর্যন্ত। পরে তরিগুলো কিশোরগঞ্জে চলে যায়। 

১০ অক্টোবর দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি তরিতে শিক্ষার্থীরা রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে তারা। সঙ্গে আছেন অভিভাবকেরাও। প্রতিটি নৌকায় দুজন করে শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের এ বিষয়ে আগেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞানতরীতে ঢুকে দেখা যায়, নানা উপকরণ সাজিয়ে রাখা। শিক্ষার্থীরা সেগুলো ব্যবহার করছে। কেউ খেলছে ভারসাম্যের খেলা, আবার কেউবা দেয়ালে রাখা ভুবনবিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনী পড়ছে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাফওয়ান আহমদ এখানে দুই দিন এসেছে। সঙ্গে তার স্কুলের আরও শিক্ষার্থী আছে। সাফওয়ান বলে, এখানে এসে সে সৌরজগৎ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে। কীভাবে দিন–রাত হয়, সেটি জেনেছে। এই তরিতে থাকা শিক্ষকেরা হলেন সোনিয়া আক্তার ও রিপা রানী সরকার। 

জানা গেল, বিজ্ঞানতরীতে আনন্দদায়ক নানা অ্যাকটিভিটি, পরীক্ষণ ও খেলার মাধ্যমে বিজ্ঞানের তথ্য ও তত্ত্বের প্রয়োগ, বাস্তব উপকরণ পর্যবেক্ষণ ও হাতে-কলমে চর্চার মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের সমাধান, বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে শিক্ষণীয় দেয়ালচিত্র, পেরিস্কোপের সাহায্যে দৃষ্টিসীমার বাইরের বস্তু দেখাসহ মজার মজার নকশা তৈরির সুযোগ রয়েছে।

মূল্যবোধতরীতে ছবি দিয়ে বিভিন্ন দিবসের সঙ্গে মিল করছিল জামালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আল মামুন। সে বলে, ‘অনেক কিছুই শিখছি। বই পড়েছি। মজার মজার খেলা আছে। প্রজেক্টরে মজার গল্প দেখানো হয়েছে। কীভাবে সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করব, সেগুলো সেখানো হয়েছে।’ তিন বছর বয়সী রোশান আহমদকে নিয়ে এসেছে বড় বোন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহমিদা আক্তার। ফাহমিদা বলেন, শিশুরা আনন্দ পাচ্ছে, আবার নানা বিষয়ে শিখছে। 

মূল্যবোধতরিতে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে মূল্যবোধসংক্রান্ত গল্প উপস্থাপন, জেন্ডার, পরিবেশ, মানবিক সুস্থতাবিষয়ক পাজল, ফ্ল্যাশ কার্ড দিয়ে সমস্যা সমাধান, বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে সহমর্মিতার চর্চা ও শিক্ষা গ্রহণ, শিক্ষণীয় দেয়ালচিত্র ও মূল্যবোধের ওপর তৈরি বিভিন্ন গল্পের বই পড়ার সুযোগ রয়েছে। 

গণিততরীর এককোণে টেবিলের ওপর ছোট ছোট কার্ড দিয়ে সংখ্যা মেলাতে ব্যস্ত ছিল চার বছর বয়সী রক্তিম নন্দী সাম্য। আলাদীনী নন্দী নাতিকে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, গণিততরীতে খেলার মাধ্যমে যোগ, বিয়োগ, ভাগ ও গুণফল বের করার সুযোগ, ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ করার নির্দিষ্ট কর্নার, গণিতের বিভিন্ন ধারণা যেমন পিথাগোরাসের তত্ত্বের মজার প্রমাণ ও বিখ্যাত গণিতবিদদের দেয়ালচিত্র রয়েছে।

জামালগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের আহ্বায়ক আকবর হোসেন বলেন, শিশুদের আনন্দময় পরিবেশে বিভিন্ন বিষয়ে জানা ও শেখার এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ৭ থেকে ১০ দিন একটি স্থানে অবস্থান করে তরিগুলো। প্রতিটি তরিতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও পরিচ্ছন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। স্থানীয়ভাবে খণ্ডকালীন দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় প্রতিটি তরির জন্য। 

এ প্রকল্পের কর্মসূচি কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার রায় বলেন, অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি ভীতি আছে। সেটা দূর করতে এবং প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, গণিত ও মূল্যবোধের শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলাই এই কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য।