মৌসুম শুরুর আগেই বিশ্বনাথে ‘২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া’ উৎসব

আজ শনিবার বেলা ১১টায় সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোয়াহরি বিলে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া মাছ ধরার উৎসবছবি: আনিস মাহমুদ

শুষ্ক মৌসুমে হাওর ও বিলের পানি শুকিয়ে আসে। গ্রামের মানুষ তখন দল বেঁধে পলো ও হাতাজাল দিয়ে মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠেন। তবে এবার শুষ্ক শীতের মৌসুম শুরুর আগেই সিলেটে বিশ্বনাথের গোয়াহরি বিলে হয়ে গেল পলো বাওয়া উৎসব। মূলত মৌসুমের আগেই বিলের পানি শুকিয়ে আসায় এ উৎসব করেছেন গ্রামের মানুষ। এতে মাছও ধরা পড়েছে প্রচুর।

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোয়াহরি বিলসংলগ্ন গোয়াহরি গ্রামের বাসিন্দারাই মূলত এ উৎসবের আয়োজন করেন। সাধারণত মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহে কনকনে শীতে বিলে পলো বাওয়া উৎসব হয়। কিন্তু এবার বিলের পানি শুকিয়ে আসায় মৌসুমের আগেই মাছ ধরার আয়োজন করতে হয়েছে। এটি ওই গ্রামের প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা।

শীত মৌসুমের আগেই বিলের পানি শুকিয়ে আসায় আজ শনিবার এ উৎসব করেছেন গ্রামের মানুষ
ছবি: আনিস মাহমুদ

আজ সকালে গোয়াহরি বিলে গিয়ে দেখা যায়, পলো বাওয়া উৎসব ঘিরে সকাল থেকেই বিলের চারপাশে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মাছ শিকারিরা। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার হাতেই মাছ ধরার সরঞ্জাম। শিশুদের হাতে ঠেলা জাল এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা পলো নিয়ে প্রস্তুত নিচ্ছেন। ১১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক এক ব্যক্তি পলো বাওয়া উৎসব শুরুর ডাক দিলে একসঙ্গে বিলে নামেন সবাই। শুরু হয় বিলের মধ্যেই মাছ ধরার উৎসব। শিশু, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ মিলিয়ে সহস্রাধিক মানুষ বিলে পলো ও জাল দিয়ে মাছ ধরতে থাকেন। বিলে এবার প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা পড়েছে। এর মধ্যে ঠেলা জাল দিয়ে ছোট মাছ ও ট্যাংরা ধরা পড়েছে বেশি। বিল থেকে বালতিতে ভরে ছোট মাছ তুলতে দেখা গেছে অনেককে।

বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরা দেখছিলেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী হাসিনুজ্জামান (৫৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে মাছ ধরতে নিজে নেমে যেতেন। কিন্তু এবার প্রখর রোদ থাকায় নামেননি। তবে তাঁর ভাইসহ অন্যরা মাছ ধরছেন। তাঁদের উৎসাহ দিতে তিনি পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

গ্রামের প্রতিটি ঘরের একজন করে উৎসবে মাছ ধরার অনুমতি পান। প্রবাসীরাও বিদেশ থেকে গ্রামে আসেন উৎসবে অংশ নিতে
ছবি: আনিস মাহমুদ

সালাম করিম (৪৫) নামের আরেক যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বলেন, ‘তরুণ বয়সে বিলে মাছ ধরতাম। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছি। এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়িতে এসে বিলে মাছ ধরায় অংশ নিচ্ছি। মাছ ধরতে নেমে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে।’ দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিনি পাঁচটি মাছ ধরতে পেরেছেন বলে জানান।

শিশু, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ মিলিয়ে গোয়াহরি গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ বিলে পলো ও জাল দিয়ে মাছ ধরেন
ছবি: আনিস মাহমুদ

গোয়াহরি গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত গোয়াহরি বিলে পলো–বাওয়া উৎসবে অংশ নেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামের প্রতিটি ঘরের একজন করে উৎসবে মাছ ধরার অনুমতি পান। উৎসবকে ঘিরে প্রবাসীরাও বিদেশ থেকে গ্রামে আসেন। গ্রাম পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বছরে ছয় মাস শুষ্ক মৌসুমে মাছ শিকার করেন গ্রামের বাসিন্দারা। মাঘ মাসে উৎসব শুরুর আগে বিলে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। তবে এবার বন্যার পর আর বৃষ্টি না হওয়ায় বিলের পানি শুকিয়ে যায়। ফলে মাঘের আগেই মাছ ধরার আয়োজন করতে হয়েছে।

গোয়াহরি গ্রামের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, পলো–বাওয়া উৎসব তাঁদের পূর্বপুরুষদের থেকে এসেছে। এটি ২০০ থেকে ২৫০ বছরের ঐতিহ্য। এবার বিলে প্রচুর মাছ ধরা পড়েছে। এর মধ্যে বোয়াল, ঘাঘট, রুই, কার্প, কাতলা, মৃগেল, শোল, গজার, ট্যাংরা মাছসহ নানা জাতের মাছ ধরা পড়েছে। বন্যার পানিতে বিল প্লাবিত হওয়ায় বিভিন্ন জায়গার মাছ বিলে জমা পড়েছে। তিনি বলেন, এবার দুই দফা বন্যার পর বৃষ্টিবাদল হয়নি। এতে বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রচুর খরতাপে কম পানির কারণে মাছগুলো উত্তাপে মারা যাচ্ছে। এ জন্য মৌসুমের আগেই পলো–বাওয়া উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। তবে বিলে পানি থাকলে মাঘ মাসে আবারও উৎসবের আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।

বোয়াল, ঘাঘট, রুই, কার্প, কাতলা, মৃগেল, শোল, গজার, ট্যাংরা মাছসহ নানা জাতের মাছ ধরা পড়েছে এবার
ছবি: আনিস মাহমুদ

দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও গোয়াহরি গ্রামের বাসিন্দা গোলাম হোসেন বলেন, বিলে পানি কমেছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে। আগে শুকনো শীতের মৌসুমে বিলে যেখানে কোমরপানি থাকত, এখন বর্ষার পরপরই পানি কমে যায়। এতে বিলের মাছগুলো খরতাপে মরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিলে এবার প্রচুর মাছ হয়েছে। যাঁরা নেমেছেন, সবাই মাছ পেয়েছেন। যদিও মাছ আরও কয়েক মাস থাকলে আকারে আরও বড় হতো। কিন্তু পানি কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে মাছ ধরে নিতে হচ্ছে।