গাছের চারা বেচে সংসারের হিসাব মেলাতে পারছেন না ষাটোর্ধ্ব মিনহাজ
শরতের কোমল, পরিপাটি সকাল। পাতার ফাঁক গলে সূর্যের সিগ্ধ আলোর কণা পড়েছে খুলনা শহরের হাদিস পার্কের ঘাসের ওপর। ঘাসে জমা শিশির মুক্তদানার মতো চকচক করছে। পার্কের ভেতরে ও বাইরে ছোট ছোট দলে অনেকে হাঁটছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও তরুণেরাও আছেন হাঁটার দলে। নারীরাও হাঁটছেন নিজেদের মতো করে।
পার্কের ‘দখিনা’ গেটের পাশে লোয়ার যশোর রোড আর পিসি রায় রোড মিশেছে। দুই রাস্তার সংযোগের ছোট ট্রাফিক আইল্যান্ডের ওপর ঝুড়িতে লাউ আর মরিচের চারা বিক্রি হচ্ছে। অনেকে ব্যায়াম শেষে বাড়ি ফেরার পথে চারা কিনছেন। মিনহাজ চৌধুরী নামে ৬৩ বছরের এক বৃদ্ধ চারাগুলো বিক্রি করছেন। মিনহাজের বাড়ি ঝালকাঠি সদরের চৌদ্দগ্রামে। প্রায় ৩০ বছর আগে তিনি খুলনা শহরে এসেছেন। এখন থাকছেন দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা মধ্যপাড়া এলাকায়।
কথায় কথায় জানা গেল, ১৯৭৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন মিনহাজ। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি। জীবিকার তাগিদে তখন চলে আসেন খুলনায়। মিনহাজের বাবা আগে থেকেই খুলনায় সবজির ব্যবসা করতেন। মিনহাজও এখানে এসে বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করতে থাকেন। বাবার মৃত্যু মারা যাওয়ার পর নিজেই ব্যবসাটা চালিয়ে যান। ব্যবসা করে এক ছেলে আর দুই মেয়েকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা এখন সবাই আলাদা থাকেন। মিনহাজের কাঁচামালের ব্যবসাও এখন আর নেই। গত চার বছর ধরে তিনি পাড়া–মহল্লা আর বাজার ঘুরে সবজির চারা বিক্রি করেন।
মিনহাজ বলেন, ‘চার বছর আগে ডেঙ্গুজ্বর হয়েছিল। তারপর থেকে শরীর খারাপ। কাঁচামালের (সবজি) ব্যবসা বন্ধ করেছি, শরীরে আর কুলায় না। ওই ব্যবসাতে খাটাখাটনি বেশি, গায়ে জোর লাগে।’
প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে রওনা দেন মিনহাজ। মাহিন্দ্রায় চড়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসেন শহরের সদর হাসপাতাল ঘাটে। ওই ঘাটে বরিশাল থেকে চারা আসে। সেই চারা কিনে সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে চলে আসেন পার্কের মোড়ে। সর্বোচ্চ থাকেন আটটা পর্যন্ত। তারপর কোনো বাজারে গিয়ে বসেন। কোনো দিন টুটপাড়া জোড়াকল বাজার, কখনো মিস্ত্রিপাড়া বাজার, কখনো বা শেখপাড়া বাজার। বাজারে বসে সব চারা বিক্রি করতে না পারলে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে চারা বিক্রি করেন। মূলত লাউ, কুমড়া, মরিচ, পেঁপে, টমেটো আর বেগুনের চারা বিক্রি করেন মিনহাজ।
মিনহাজ বলেন, দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে সব চারা বিক্রি হয়ে যায়। প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার চারা কেনেন তিনি। ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে। তবে সব সময় চারার সরবরাহ ভালো থাকে না। আবার ভাদ্র থেকে মাঘের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত—সর্বোচ্চ ছয় মাস বিক্রি হয়। মিনহাজের নিজস্ব কোনো ভ্যান নেই। তাই বড় চারাও বিক্রি করতে পারেন না তিনি। বছরের অন্য সময় মিনহাজ দৌলতপুর বাজারে শাক বিক্রি করেন।
স্বামী আর স্ত্রী দুজন মিলে মিনহাজের সংসার। মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়েই বাসাভাড়া, পানি, বিদ্যুতের বিল আর বাজারের খরচ সামলাতে হয়। মিনহাজের স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। সেখান থেকে আসে হাজার দুয়েক টাকা। দুজনের টাকায় কোনোমতে সংসার টেনে নিচ্ছেন তাঁরা।
মিনহাজ বলেন, ‘আগে আয় ভালো ছিল। ছেলেমেয়েদের কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছি। বিয়ে দিয়েছি। তখন সংসার ভালো চলত, যা আয় করেছি, সব সংসারে গেছে। এখন কোনোমতে টিকে আছি। ভালো কিছু খাইতে পারি না। খাওয়াদাওয়ায় শাকসবজি বেশি চলে। মাছ, মাংস হয়তো সপ্তাহে সর্বোচ্চ এক থেকে দুইবার। আসলে দাম বাড়াটা আমাদের জন্য বিশাল সমস্যা হয়ে গেছে। জীবন আর সংসারের কোনো হিসাবই তো ঠিকমতো মেলে না।’
মিনহাজের ভাষ্যমতে, সবচেয়ে সমস্যা হয়েছে চাল আর তেলের দাম বাড়ায়। তিনি বলেন, ‘৪৫ থেকে ৫০ টাকার যেই চাল কিনি, সেই ভাত আসলে ঠিকমতো খাওয়া যায় না। ভাত তো ভালো হয়ই না আবার ভেজাল থাকে। আমাদের তো ৬৮ থেকে ৭০ টাকার চাল কিনলে চলবে না। আবার আমরা এখানকার ভোটার হলেও ন্যায্যমূল্যের বা অন্য কোনো সুবিধা পাই না। দলীয় লোক যাঁরা, যাঁদের কাজে লাগে, তাঁরাই এসব পান। আমরা তো নিরিবিলি থাকি। তাই আমাদের কথা কেউ মনেও রাখেন না।’