শত বছর ধরে যে জলে জ্বলছে আগুন

শত বছর ধরে আগুন জ্বলছে অগ্নিকুণ্ড মন্দিরের কূপের পানিতে। পূর্ণার্থী ও পর্যটকেরা বেড়াতে আসেন এ মন্দিরে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের অগ্নিকুণ্ডেপ্রথম আলো।

চারদিকে সবুজ পাহাড়। মাঝখানে একটি টিলায় পুরোনো দ্বিতল ভবন। ভবনের ভেতরে একটি ছোট কূপ। সেই কূপের একটি অংশে পানির ওপরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।

এক–দুই দিন ধরে নয়, শত শত বছর ধরেই জ্বলছে এই আগুন। আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে লক্ষ্যে ওই অংশের চারপাশে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা দেয়াল। দেয়ালের কারণে দেখতে মনে হয়, একটি চুলায় আগুন জ্বলছে। আগুনের আঁচে এর পাশে দাঁড়ানোই কষ্টকর। পানির ওপরিভাগে আগুন জ্বললেও পানি কিন্তু ঠান্ডা।

যে কূপে পানির ওপর আগুন জ্বলছে, এর নাম বাড়বানল। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি অতি পবিত্র তীর্থস্থান, পরিচিত অগ্নিকুণ্ড মন্দির নামে। এর অবস্থান চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের বাড়বকুণ্ড পাহাড়ে। প্রতিবছর শিবচতুর্দশী উপলক্ষে লাখো পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে এই তীর্থস্থানে। এ ছাড়া সারা বছরই পর্যটকেরা বাড়বানল দেখতে যান।

অগ্নিকুণ্ড মন্দিরে একদিন

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে বাড়বকুণ্ড বাজার। বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়ের একটি টিলায় মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরে যাওয়ার পথের দুই ধারে রয়েছে পেয়ারাবাগান। পাকলে ভেতরে লাল হয় এই পেয়ারার। বাণিজ্যিকভাবে সীতাকুণ্ডে সবচেয়ে বেশি লাল পেয়ারার উৎপাদন হয় এখানে। পেয়ারাবাগানের শেষ হলে তমালগাছের নিচে শনিবাড়ী। মূলত বাড়বকুণ্ডের তীর্থ শুরু সেখান থেকেই। সেখানে ছোট একটি টিলায় পাশাপাশি আটটি মন্দির। তারই একটি অগ্নিকুণ্ড মন্দির।

টিলার ওপরে অগ্নিকুণ্ড মন্দিরের ভবনটি চুন–সুরকি ও সরু ইট দিয়ে নির্মিত। ছাদ নেই। নিচতলার বারান্দার ছাদ থেকে খসে পড়ছে ইট। সিঁড়ি ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। নিচতলায় কুণ্ডটির অবস্থান। এখানে দুটি শিবলিঙ্গ আছে। এখানে আগে কষ্টিপাথরের বিগ্রহ ছিল।

২০১১ ও ২০১৩ সালে দুটি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ চুরি হয়ে যায়। অবশ্য র‌্যাব-৭ একটি শিবলিঙ্গ উদ্ধার করেছে। সেটি সমতলে থাকা কালীমন্দিরে রাখা হয়েছে বলে মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

বাড়বানলের এ অগ্নিকুণ্ডের নাম অনুসারে ইউনিয়নটির নাম হয়েছে বাড়বকুণ্ড। সরকারের জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটেও বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, চন্দ্রনাথ তীর্থ পরিক্রমা সম্পূর্ণ করতে প্রথমে অগ্নিকুণ্ডের জল দ্বারা পবিত্র হতে হয়। এরপর চন্দ্রনাথ তীর্থের আনুষঙ্গিকতা শেষ করতে হয়। পরে বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের লবণাক্ষ তীর্থ পরিক্রমা করলেই চন্দ্রনাথ তীর্থ সম্পন্ন হয়।

কেন আগুন জ্বলে

দুই পাশে পাহাড় আর পেয়ারার বাগান। এই পথ ধরে যেতে হয় অগ্নিকুণ্ড মন্দিরে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের অগ্নিকুণ্ডে
প্রথম আলো।

বিজ্ঞানীদের মতে, মিথেন গ্যাসের কারণে সব সময় কূপটিতে আগুন জ্বলে। সেখানে বেশ কয়েকবার জরিপও হয়েছিল। কিন্তু উত্তোলন করার মতো গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। যার কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে সেটি রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) উপব্যবস্থাপক মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাড়বকুণ্ড এলাকায় একাধিকবার জরিপ হয়েছে। সেখানে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনের মতো কোনো গ্যাস নেই। খুব সম্ভবত সেখানে পকেট গ্যাস রয়েছে। কম চাপসম্পন্ন হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে জ্বলছে। নতুবা অন্য কোথাও গ্যাসের মজুত আছে, যা ভূমির তল দিয়ে আনুভূমিক এসে ওই এলাকায় উল্লম্বভাবে বের হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, দৈব শক্তিতে বাড়বকুণ্ডের অগ্নিকুণ্ডে সুপ্রাচীনকাল থেকেই আগুন জ্বলছে। শিব ও শক্তির সমন্বিতভাবে প্রভাবে অগ্নিদেবতার উপস্থিতিতে আগুন জ্বলছে বলেই পূজা করা হয়।

অগ্নিকুণ্ড ও মন্দিরের বয়স কত

প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অগ্নিকুণ্ড মন্দিরটি বয়স নির্ধারণ না করায় সঠিক বয়স এখনো জানা যায়নি। চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রথম আলাকে বলেন, তাঁদের লোকবলসংকট ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রাম জেলায় পুরাকীর্তিগুলোর জরিপ হয়নি। তিনি এ বিষয়ে তাঁদের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন। আগামী সপ্তাহে জরিপকাজ পরিচালনার জন্য একটি প্রস্তাবনা দেবেন। ওই প্রস্তাবনা পাস হলে সীতাকুণ্ড থেকেই তাঁরা জরিপ শুরু করবেন।

অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী বলেন, চন্দ্রনাথ পঞ্চক্রোশের একটি মহাতীর্থস্থান অগ্নিকুণ্ড। এ অগ্নিকুণ্ডকে ঘিরে সুপ্রাচীনকাল থেকেই শিবের অষ্টমূর্তির প্রতীকে অষ্টলিঙ্গমূর্তি প্রতিষ্ঠিত। আর তাকে ঘিরেই মন্দির। ঠিক কবে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার তথ্য পাওয়া না গেলেও ১৫০১-১৫১০ সালের মধ্যে ত্রিপুরার রাজা ধন্যমাণিক্য চট্টগ্রামে এসে অগ্নিকুণ্ড মন্দিরটি সংস্কার করেন বলে ধারণা। এ সময় দেবীবিগ্রহ নিয়ে ত্রিপুরায় ত্রিপুরাসন্দুরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

মন্দিরের পুরোহিত নির্মল ভট্টাচার্য বলেন, বংশপরম্পরায় তাঁরা মন্দিরের পূজা–অর্চনা করছেন। তিনি নিজেও ৫৫ বছর ধরে মন্দিরে পূজা দিয়ে আসছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, মন্দিরটি এক হাজার বছরের বেশি পুরোনো।