কুয়েতে আর যাবেন না জাকির, খেজুরবাগানে শান্তির খোঁজ

জাকির হোসেনের বাগানের খেজুর। ১০ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ঢাকা মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ঢাকা মোড় থেকে রংপুর যাওয়ার রাস্তায় ডানদিকে শুরুতেই চোখে পড়বে হাস্কিং মিলের চাতাল ও গুদামঘর। পাশেই প্রায় ২০ শতক জমিতে ইটের প্রাচীরঘেরা। রাস্তা থেকে অনুমান করা যায়, প্রাচীরের উচ্চতা ভেদ করে মাথা দোলাচ্ছে খেজুরগাছের পাতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রাচীরের ভেতরে খেজুরগাছের বাগান আছে। প্রায় প্রতিটি গাছে ফলও এসেছে। গাছগুলোর বয়স ৪-৫ বছর হলেও স্থানীয় লোকজনের অনেকেই জানেন না এই খেজুরবাগানের কথা।

গুদামঘরের পাশেই পাওয়া গেল বাগানের মালিক জাকির হোসেনকে (৪৫)। এরপর আলাপচারিতা ও বাগান ঘুরে দেখা। বাগানে ১৯টি খেজুরগাছ। সারি সারি সমান দূরত্বে লাগানো। প্রতিটি গাছের উচ্চতা বড় জোর ২০-২৫ ফুট। এর মধ্যে ১১টি গাছের একেবারে গোড়ার দিকে ঝুলে আছে ১-৯টি পর্যন্ত খেজুরের কাঁদি। প্রতিটি কাঁদিতে ১০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত খেজুর হবে বলে জানালেন জাকির হোসেন। খেজুরগুলোর রং হলুদ, কোনটি সবুজ, কোনটি আবার গাঢ় লালচে। বাঁশের খুঁটিতে খেজুরগাছ ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে। পাশেই নতুন করে খেজুরগাছের চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে নার্সারির বেডে। সেই চারাগুলোর বয়সও এক-দেড় বছর।

তাঁর পৈতৃক কিছু জমিজমা আছে। আর কুয়েতে ফিরবেন না। দেশে অন্য রকম শান্তি আছে, ভালো লাগা আছে। স্ত্রী-সন্তানকে সময় দিয়ে পুরো সময়টা খেজুরবাগান নিয়েই কাটিয়ে দেবেন।
জাকির হোসেন, খেজুর চাষি
মরুর দেশের খেজুর চাষ করেছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার জাকির হোসেন। ১০ আগস্ট উপজেলার ঢাকা মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

জাকির হোসেন বলেন, ‘খেজুর মরুর দেশের ফল হিসেবেই সুপরিচিত। সাধারণত বেলে দোআঁশ মাটি খেজুর চাষের জন্য উপযোগী। আমাদের দেশে খেজুরগাছের দেখা পাওয়া গেলেও ঠিক মরু অঞ্চলের মতো ফলন কিংবা স্বাদ মিলে না।’

১৯৯৫ সালে এসএসসি পাস করেন জাকির। তারপর চাকরি খুঁজতে চলে গেছে চার বছর। ১৯৯৯ সালে এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে কুয়েতপ্রবাসী হন। শুরুতেই কুয়েতের শুয়াইখ শহরে মোটর গ্যারেজে চাকরি নেন। এরপর ধীরে ধীরে কর্মচারী থেকে গ্যারেজের মালিক হন। জাকির বললেন, শুয়াইখ শহরে প্রতিটি বাড়িতে, রাস্তায় প্রায় সব খানে খেজুরগাছে ভরা। বলতে গেলে ওখানকার মানুষের প্রধান ফসল হচ্ছে খেজুর। সেটা দেখে নিজের দেশে খেজুরবাগান করার পরিকল্পনা করেন। চাষের পদ্ধতিও শিখে নেন শুয়াইখ শহরে খেজুরচাষিদের কাছে।

খেজুর ঝুলছে গাছে। ১০ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ঢাকা মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

২০১৭ সালের শুরুতে ছুটিতে দেশে আসেন জাকির হোসেন। সেই সময় সঙ্গে নিয়ে আসেন বিভিন্ন জাতের ১২ কেজি পাকা খেজুর। তা থেকে বীজ সংগ্রহ করে একটি বেডে মাটি প্রস্তুত করে তাতে বীজ রোপণ করেন। কয়েক দিনের মাথায় ফিরে যান কুয়েতে। স্বজনদের কাছে জানতে পারেন বীজ থেকে চারা গজিয়েছে। মুঠোফোনে খেজুরগাছের খবর নিতেন। গাছগুলোর ছবি পাঠাতেন স্বজনেরা। ২০১৯ সালের জুনে জাকির সিদ্ধান্ত নেন এবার দেশে গিয়ে থিতু হবেন। আবার পাঁচ কেজি খেজুর সঙ্গে নিয়ে দেশে আসেন। এবার চারাগুলোকে ১৫-২০ ফুট দূরত্বে লাগিয়ে দেন। বাড়ি ফিরে জাকির এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। পাশাপাশি খেজুরের বাগান পরিচর্চা, চারা তৈরিসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফলের চাষ করছেন। খেজুরবাগানে তিনি শান্তির খোঁজ পেয়েছেন। সেই সঙ্গে আছেন অর্থনৈতিক সাফল্যের পথে।

জাকিরের বাগানে মরিয়ম, আজওয়া, খলিজি, মেডজল ও আম্বার জাতের খেজুরগাছ রয়েছে। গত বছর তিনটি গাছে অল্প পরিমাণ ফলন আসলেও এবার ১১টি গাছে আশানুরূপ ফলন ধরেছে। আকৃতির দিক থেকে খেজুরগুলো কোনটি গোলাকৃতির, কোনটি লম্বা। এ ছাড়া লেবু ও ড্রাগনের চাষ শুরু করেছেন। খেজুরবাগান দেখতে প্রতিনিয়ত স্থানীয় লোকজন ভিড় করছেন। প্রায় সময় দর্শনার্থীদের খেতে দিচ্ছেন একটি দুটি খেজুর। ইতিমধ্যে পাইকারি ব্যবসায়ী এসে দাম হাঁকিয়েছেন প্রতি কেজি খেজুর ৪৫০ টাকা। কিন্তু জাকির সেই দামে বিক্রি করবেন না।

জাকিরের বাগানে মরিয়ম, আজওয়া, খলিজি, মেডজল ও আম্বার জাতের খেজুরগাছ রয়েছে। গত বছর তিনটি গাছে অল্প পরিমাণ ফলন আসলেও এবার ১১টি গাছে আশানুরূপ ফলন ধরেছে।
খেজুর গাছের চারা পরিচর্যা করছেন জাকির হোসেন। ১০ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ঢাকা মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

জাকিরের ভাষ্য, আর এক মাস পরে ফল সংগ্রহ করবেন। শুকিয়ে বিক্রি করতে পারলে ৬০০-১৪০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি খেজুর বিক্রি করতে পারবেন। তবে প্রথমবারের ফলন তিনি পাইকারকে দিতে চান না। নিজেই খুচরায় বিক্রি করবেন। নতুন করে চারা লাগিয়েছেন দুই হাজার। রোপণের উপযুক্ত হয়েছে চারাগুলো। ৩ একর জমি প্রস্তুত করার কাজ চলছে। জমি প্রস্তুত হলে পুরো জমিতেই খেজুরের বাগান করবেন। অনেকেই চারার জন্য আগাম বলে রেখেছেন জাকিরকে। প্রতিটি চারার দাম রাখছেন এক হাজার টাকা। তিনি বলেন, খেজুরগাছ সব ধরনের মাটিতে হয়। তবে বেলে দোআঁশ মাটি হলে ভালো। জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। বালি-ছাই-গোবর ও কম্পোস্ট সার মিশিয়ে কয়েক দিন রেখে দিতে হবে। তারপর খেজুর থেকে প্রাপ্ত বীজ ৪০ থেকে ৪৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে মাটিতে আধা ইঞ্চি গর্তে বীজ রোপণ করতে হবে। নিয়মিত অল্প পরিমাণ পানি দিতে হবে যেন জমিতে কাদা না হয়। এভাবে চার সপ্তাহের মধ্যে বীজ থেকে চারা গজাবে।

আরও পড়ুন
এমন খেজুর দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। সম্প্রতি জাকির হোসেনের খেজুরবাগানে
ছবি: প্রথম আলো

তিন সন্তানের বাবা জাকির হোসেন বলেন, তাঁর পৈতৃক কিছু জমিজমা আছে। আর কুয়েতে ফিরবেন না। দেশে অন্য রকম শান্তি আছে, ভালো লাগা আছে। স্ত্রী-সন্তানকে সময় দিয়ে পুরো সময়টা খেজুরবাগান নিয়েই কাটিয়ে দেবেন। ইতিমধ্যে উপজেলা কৃষি অফিসের লোকজন তাঁর বাগান দেখতে এসেছেন। তাঁরা সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিচ্ছেন।

জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, জাকিরের খেজুরবাগান তিনি পরিদর্শন করেছেন। মোট ছয় জাতের খেজুর আছে তাঁর বাগানে। ইতিমধ্যে কিছু চারাও প্রস্তুত করেছেন। তিনি যাতে বাণিজ্যিকভাবে খেজুরবাগান করতে পারেন এবং অন্যরা খেজুরবাগান করতে এগিয়ে আসেন, সে জন্য তাঁরা কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু মরুর দেশের ফল আমাদের দেশে সুন্দর সম্ভাবনা তৈরি করেছে, ফলে কৃষকেরাও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কৃষি বিভাগ জাকিরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।’