নওগাঁ
স্মৃতিফলকটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
জেলায় চিহ্নিত ৬৭টি বধ্যভূমির মধ্যে ১২টি বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিফলক রয়েছে। ৬২টি বধ্যভূমিই অরক্ষিত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ নভেম্বর নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার হালিমনগরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৩৬ জনকে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে গুলিতে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। হালিমনগর খালসংলগ্ন বধ্যভূমির একাংশে স্থানীয় উদ্যোগে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় ওই স্থান এখন আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে।
শহীদ পরিবারের সদস্য কার্তিক মুর্মু বলেন, ‘একাত্তরে শহীদদের এই কবরগুলাত অ্যাখন গরু-ছাগল চরে বেড়ায়। যে স্থানটাতে সেদিন লাশ পড়্যাছিল, সেগুলাত অ্যাখন মানুষ আবাদ করে খায়। একটা স্মৃতিফলক করা হছে, সেটাও নষ্ট হয়ে যাছে।’
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও নওগাঁর অধিকাংশ বধ্যভূমি এখনো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
অযত্নে-অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হতে যাওয়া তেমনই এক বধ্যভূমি মান্দা উপজেলার মনোহর বধ্যভূমি। বিজয়ের তিন দিন আগে একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে নওগাঁর মান্দা উপজেলার মনোহরপুর এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা। ওই দিন গ্রামটিতে মুক্তিকামী ১৬ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়।
সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন মনোহর গ্রামের ফইমালী বেওয়ার (৭৫) স্বামী আছির উদ্দিন ও বাবা লাল মোহাম্মদ। স্বাধীনতাযুদ্ধের নীরব সাক্ষী ফইমালী বেওয়া বলেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধে শ্যাষ হওয়ার তিন দিন আগে বিকেল ব্যালা পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা হামাগের পুরা গ্রাম ঘিরে ফ্যালে। সেদিন ওরা গ্রামের ১০-১২টা বাড়ি পুড়ায়ে দেয়। ওদের হাতে হামার স্বামী, বাপসহ ১৮ জন ধরা পড়ছিল। পরে গ্রামের পাশে ভালাইন বিলের ধারত লিয়ে গিয়ে ওদেরকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। ভাগ্যচক্রে দুজন ব্যাঁচে গেলেও হামার স্বামী, বাপসহ ১৬ জন সেদিন শহীদ হন।’
শহীদ পরিবারের সদস্য মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে শুনছুনো কবরস্থানটার চারপাশত নাকি প্রাচীর হবে। পরে তো আর হলো না। স্মৃতিফলক করা হছে, কিন্তু সেটাতে লেখা শহীদদের নামগুলো আর পড়া যায় না।’
২০১৬ সালে সরকারি উদ্যোগে ওই স্থানে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। সেই বছরই বধ্যভূমির স্থানটিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু জমি নিয়ে বিরোধের কারণে পরবর্তী সময়ে প্রাচীর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে এখনো সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ হয়নি। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় বধ্যভূমিটি সারা বছর অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস নওগাঁ জেলা বইয়ের লেখক আইয়ুব হোসেন নওগাঁয় ৩০টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ২০১৯ সালে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ প্রকাশিত ও তরুণ গবেষক মোস্তফা-আল-মেহমুদ সম্পাদিত গণহত্যা ১৯৭১ নওগাঁ বইয়ে ৬৭টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংগঠনটি প্রায় দুই যুগ ধরে ১৯৭১ সালে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁয় চিহ্নিত ৬৭টি বধ্যভূমির মধ্যে ১২টি বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিফলক রয়েছে। এগুলো হলো সদর উপজেলার দোগাছি ও ফতেপুর; আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া ও শিংসাড়া; রানীনগরের আতাইকুলা, মান্দার পাকুড়িয়া ও মনোহরপুর; মহাদেবপুরের বাজিতপুর-চকদৌলত; পত্নীতলার হালিমনগর; ধামইরহাটের কুলফতপুর; বদলগাছির গয়েশপুর ও পাহাড়পুর। এগুলোর মধ্যে নওগাঁর পার-বোয়ালিয়া, মান্দার পাকুড়িয়া, আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া, বদলগাছির গয়েশপুর ও পাহাড়পুর বধ্যভূমিতে সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। উল্লিখিত এই পাঁচ বধ্যভূমি ছাড়া বাকি ৬২টি বধ্যভূমিই অরক্ষিত।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তরুণ গবেষক ও একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা আল মেহমুদ বলেন, ২০১৯ সালে প্রকাশিত গণহত্যা ১৯৭১ নওগাঁ বইটির প্রথম সংস্করণে নওগাঁয় ৬৭টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ১০০টির অধিক গণহত্যার স্থান ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। বইটির পরবর্তী সংস্করণে বাকিগুলোর কথা উল্লেখ করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রায় অর্ধশত গণকবর রয়েছে নওগাঁয়। অথচ স্বাধীনতার ৫২ বছরেও অনেক গণকবরই সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রশাসনের দায়িত্ব।’