হাওরের মাঝে থাকেন ৬ মাস, বিনিময়ে পান গোলাভরা ধান

বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে শত শত কুঁড়েঘর জিরাতি বাড়ি হিসেবে পরিচিত। বোরো মৌসুমে এসব বাড়িতে আবাস গড়েন একশ্রেণির কৃষক।

কিশোরগঞ্জের হাওরে ঘুরলে এখন চোখে পড়বে এ রকম অনেক কুঁড়েঘর। এগুলোকে হাওরের ‘জিরাতি বাড়ি’ বলা হয়। এসব বাড়িতে কৃষকেরা বছরের অর্ধেক সময় পার করে বোরো ধান চাষাবাদ করেন। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের ইটনা বড় হাওরেছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এখন যত দূরে চোখ যায়, শুধু বোরো ধানের খেত। আগাম বৃষ্টির ফলে এবার বাম্পার ফলনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে ধান পাকা শুরু হবে। মাসখানেকের মধ্যে গোলায় তোলা যাবে হাওর এলাকার একমাত্র এই ফসল। বিস্তীর্ণ বোরো ধানের মাঠে হঠাৎ চোখে পড়বে কুঁড়েঘর। এগুলোকে বলা হয় জিরাতি বাড়ি। এসব বাড়িতে বসবাস করেন একশ্রেণির চাষি, যাঁরা বছরের অর্ধেক সময় সেখানে বসবাস করে ধান নিয়ে নৌকায় করে স্থায়ী বাড়িতে ফেরেন। এটা হাওরাঞ্চলের সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে।

এমন কৃষকদের একজন জামাল উদ্দিন। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার তালজাঙ্গা এলাকায়। তিনি তিন ছেলে ও দুই নাতিকে নিয়ে ইটনার বড় হাওরে জিরাতি বাড়িতে বসবাস করছেন। খড়কুটোর তৈরি একটি ঘরে গরু-ছাগলসহ ছয়জনকে নিয়ে গাদাগাদি করে তাঁর বসবাস। এখানে তাঁরা ছয় মাস থাকবেন। উদ্দেশ্য, ঘরে গোলাভরা ধান তোলা।

জমিতে ধান চাষের জন্য হাওরে খড়কুটো, ছন, টিন আর বাঁশ দিয়ে দিয়ে বানানো অস্থায়ী ঘরকে স্থানীয়ভাবে ‘জিরাতি বাড়ি’ নামে পরিচিত। আর যাঁরা এই বাড়িতে বসবাস করে ধান চাষ করেন, তাঁদের বলা হয় ‘জিরাতি কৃষক’। কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত উপজেলা নিকলী, মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রামে মেলে এসব বাড়ি। করিমগঞ্জ, তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ সদর, নিকলী, কটিয়াদী, বাজিতপুর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকার ১০ থেকে ১৫ হাজার কৃষক শুষ্ক মৌসুমে হাওরে জিরাতি বাড়িতে ঠাঁই নেন।

ইটনার বড়িবাড়ি হাওরের জিরাতি কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, জিরাতিরা নিজেদের বাড়িঘর ফেলে সুখের আশায় খড়কুটো বা টিন দিয়ে ছোট্ট কুঁড়েঘরের মতো অস্থায়ী কাঁচা ঘর তৈরি করে হাওরের মাঝখানে বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় কাটিয়ে দেন। আবার বর্ষার শুরু হওয়ার আগেই সবকিছু নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কারণ, তখন হাওর পানিতে টইটম্বুর থাকে। প্রতিবছর হাওরাঞ্চলে এভাবে ধান চাষে কৃষকদের গোলায় হাজার হাজার মণ ধান ওঠে।

পানি শুকানোর পর কার্তিক মাসের শেষের দিকে হাওরাঞ্চল ঘুরলে সারি সারি শত শত ছোট্ট জিরাতি বাড়ি চোখে পড়ে। এসব বাড়িতে কৃষকেরা বছরের কার্তিক-অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাস পর্যন্ত থাকেন। পরে এসব বাড়ি ভেঙে নৌকায় করে ধানসহ আবার যাঁর যাঁর স্থায়ী বাড়িতে চলে আসেন।

ইটনার বড় হাওরে সম্প্রতি করিমগঞ্জের নিয়ামতপুর এলাকার কৃষক খোকন মিয়া, তাড়াইলের জাওয়ার এলাকার কৃষক হানিফ মিয়া ও সদরের বৌলাই এলাকার কৃষক নাজিম উদ্দিনসহ প্রায় ২০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, প্রতিবার বোরো লাগানোর সময় থেকে তাঁরা বাড়িঘর ফেলে খড় বা টিন দিয়ে ছোট ঘর তৈরি করে হাওরের মাঝখানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন। সেখানে রোদ, বৃষ্টি ও তুফান উপেক্ষা করে বছরের অর্ধেক কাটিয়ে দিতে হয়। বিনিময়ে তাঁরা পান গোলাভরা ধান।

ষাটোর্ধ্ব কৃষক রইছ উদ্দিন বলেন, ভালো থাকার জন্য বৃদ্ধ বয়সেও পরিবারের পাঁচজনসহ গরু-ছাগল নিয়ে একটি ছোট্ট ঘরে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। সব কষ্ট চাপিয়ে বাম্পার ফলনের আশায় আছেন। ধান ঘরে তুলতে পারলে এসব কষ্টের কথা আর মনে থাকে না। তিনি আরও বলেন, প্রায় ৩৫ বছর ধরে ইটনার বড় হাওরে এভাবেই তিনি ছয় মাস অন্তর অন্তর জিরাতি বাড়িতে বসবাস করেন। ধানমাড়াই শেষে কুঁড়েঘর ভেঙে, সেচমেশিন, ধানমাড়াইয়ের মেশিন, গরু-ছাগলসহ সব নিয়ে আবার স্থায়ী বাড়িতে চলে যান।

জেলার কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কিশোরগঞ্জে এবার ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৫৩ হাজার ৬২৫ মেট্রিক টন। আশা করা হচ্ছে, এ থেকে চাল পাওয়া যাবে ৮ লাখ ৩৫ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন,  প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে এবার ধানের বাম্পার ফলন হবে। এতে হাওরের হাজারো জিরাতি কৃষকের স্বপ্ন পূরণ হবে। জিরাতিদের কষ্টার্জিত সোনালি ফসলে গোলা ভর্তি হয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠবে।