তরফ ফাজিল গ্রামে ছয় বিঘা জমিজুড়ে লিচু, আম ও লটকনের বাগান। বাগানের নিচে আধো আলো-ছায়ায় শোভা পাচ্ছে সারি সারি বস্তা। বস্তাগুলো অর্ধেক পরিমাণ মাটিভর্তি। এসব বস্তায় চাষ করা হয়েছে নানা জাতের আদা। গ্রামটি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নে অবস্থিত।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে তরফ ফাজিল গ্রাম। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, সাদুল্যাপুর-সান্দিয়াপুর সড়ক ঘেঁষে লিচু, আম ও লটকনের বাগান। বাগানে শোভা পাচ্ছে লটকন। আম ও লিচুর গাছে গুটি এসেছে। বস্তায় লাগানো আদার পরিচর্যা (নিড়ানি) চলছে। শ্রমিকদের সঙ্গে উদ্যোক্তা রুহুল আমিনও পরিচর্যার কাজ করছেন। শ্রমিকদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
রুহুল আমিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। বর্তমানে তিনি আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করছেন, কর্মস্থল সিলেট। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে তিনি বাগান পরিচর্যা করছিলেন।
রুহুল আমিন বলেন, পৈতৃক সূত্রে তাঁদের লিচুর বাগান ছিল। ২০০৬ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ শুরু করেন। প্রথম দিকে প্রায় চার বিঘা জমিতে লিচুর চাষ করেন। বছরে লাভ হতো দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। পরে বাগানে আম ও লটকন যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ছয় বিঘা জমিতে মাদ্রাজি, চায়না জাতের লিচু; হাঁড়িভাঙা, আম্রপালি জাতের আম ও লটকনের বাগান রয়েছে। বছরে লাভ হচ্ছে তিন-চার লাখ টাকা।
গত এপ্রিলে এই বাগানে ১১ হাজার ৬০০ বস্তায় আদা লাগানো হয়েছে। রুহুল আমিন জানালেন, প্রতিটি বস্তা মাটি, বালু, ছাই ও জৈব সার দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। একটি বস্তায় ৪৫-৫০ গ্রাম ওজনের আদার বীজ লাগানো হয়। প্রতি কেজি বীজ আদা ২০০ টাকায় কেনা হয়। মোট ১৬ মণ আদার বীজ লাগানো হয়েছে। মোট উৎপাদন খরচ প্রায় ৪ লাখ টাকা। ১০-১১ মাস পর ফলন পাওয়া যাবে। প্রতি বস্তায় উৎপাদন হবে এক থেকে আড়াই কেজি আদা। প্রতি কেজি আদা বিক্রি হবে ১২০-১৩০ টাকা। এ হিসাবে উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাদে ১০-১২ লাখ টাকার আদা বিক্রি করা যাবে।
বর্তমানে চারজন শ্রমিক নিয়মিত আদার বস্তার পরিচর্যার কাজ করছেন। মাসে মজুরি গড়ে ১২ হাজার টাকা। পার্শ্ববর্তী তরফ কামাল গ্রামের কৃষিশ্রমিক বকুল মিয়া (৫৫) বলেন, বছরের অর্ধেক সময় দিনমজুরদের হাতে কাজ থাকে না। এ বাগানে কাজ পেয়ে উপকার হয়েছে। মাসে যে টাকা পাচ্ছেন, তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসার চলছে।
এদিকে রুহুল আমিনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আশপাশের অনেক কৃষক বস্তায় আদা চাষ করেছেন। তরফ ফাজিল গ্রামের কৃষক মিঠু মিয়া (৪০) বলেন, বাড়ির পাশে দুই শতক জমিতে আবাদ হতো না। জমি পতিত থাকত। তাই ৫০০টি বস্তায় আদা চাষ করেছেন। একই গ্রামের বাদশা মিয়া (৫০) বলেন, ‘বসতবাড়ির উঠানে গাছের নিচে সাংসারিক কাজ হতো না। রুহুল ভাইকে দেখে ৪৫০টি বস্তায় আদা লাগিয়েছি। গ্রামের অনেকেই পতিত জায়গায় বস্তায় আদা লাগিয়েছেন।’
রুহুল আমিন সরকার বলেন, ‘চাকরির সুবাদে আমি দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে থাকি। তাঁদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পতিত জায়গা ব্যবহার ও অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের বিষয়টি ভাবতে থাকি। এ ভাবনা থেকে বস্তায় আদা চাষের উদ্যোগ নিই। বগুড়ার শিবগঞ্জের মসলা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার পরামর্শে এবং ওই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত কৃষকের কাছ থেকে বারী-১ জাতের বীজ আদা সংগ্রহ করি। এ ছাড়া বান্দরবান জেলা ও স্থানীয় বাজার থেকেও বীজ সংগ্রহ করেছি। ভবিষ্যতে বস্তায় আদা চাষের পদ্ধতিকে ইউনিয়ন, তথা জেলাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’
সাদুল্যাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মতিউল আলম বলেন, উপজেলায় ২৭২ বিঘা জমিতে আদা চাষ হয়েছে। এ ছাড়া রুহুল আমিনের বাগানসহ উপজেলায় বস্তায় আদা চাষ হয়েছে ১৫ হাজার বস্তা। এপ্রিল মাস আদা চাষের উপযুক্ত সময়। উদ্যোক্তা রুহুল আমিনকে পরামর্শ ও নানা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পতিত জায়গায় বস্তায় আদা চাষে কৃষকদের পরামর্শ ও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।