পাহাড়ছোঁয়া বাজারের মিষ্টির দোকান ‘জলযোগ’
প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। অখিল রঞ্জন দাশ নামে এক ব্যক্তি পাহাড়ছোঁয়া একটি গ্রামীণ হাটে মিষ্টির দোকান খুলে বসেন। বাড়ি থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে ওই হাট। ভাঙাচোরা পাহাড়ি কাঁকর বিছানো লাল মাটির পথ ধরে প্রতিদিন হাটে আসা–যাওয়া করেন। অনেকটাই নিস্তরঙ্গ, অচঞ্চল একটি হাট। মানুষের হইচই বলতে ওই সাপ্তাহিক হাটবারের এক-দুদিন, অন্য দিনে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের আনাগোনা থাকে। আশপাশের পাহাড়ি গ্রাম, গভীর পাহাড়ের বুকের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কিছু গ্রামের (পানপুঞ্জি) মানুষই এই হাটের প্রধান ক্রেতা।
কিন্তু একদিন অখিল রঞ্জন দাশের এই মিষ্টির দোকানই বাজারের পরিচিতিকে শুধু উপজেলা সদরে নয়; জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়। সুযোগ পেলে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া বাজারের ‘জলযোগ মিষ্টি ঘর’ ঘুরে যান অনেকে। স্থানীয় ব্যক্তিরা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে এই দোকোনের মিষ্টি পাঠান। বন্ধুবান্ধবকে ওই দোকানে মিষ্টি খাওয়াতে নিয়ে যান।
মঙ্গলবার দুপুরের দিকে মুরইছড়া বাজারের জলযোগ মিষ্টি ঘরে আসেন রোকেয়া বেগম নামের এক নারী। তাঁর বাড়ি কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামে। ঘরে তৈরি পিঠা নিয়ে মেয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। যাওয়ার পথে মুরইছড়া জলযোগ মিষ্টি ঘরের মিষ্টি নিতে এসেছেন। শুধু পিঠা দিয়েই মনে শান্তি মেলে না। সঙ্গে জলযোগের মিষ্টি হলেই যেন পিঠা দেওয়ার আয়োজন পূর্ণতা পাবে!
রোকেয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুরইছড়ার (জলযোগের) মিষ্টি–নিমকি খুব মজা। আমরা কই (বলি) মিষ্টি-নিমকি খাওতো মুরইছড়া আও (আসো)।’ কথা বলে হাসতে হাসতে জলযোগ মিষ্টি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তখনো ঘরভর্তি একদল লোক বসে জলযোগের মিষ্টির স্বাদ নিচ্ছেন।
অখিল রঞ্জন দাশ মারা গেছেন প্রায় তিন বছর আগে। মিষ্টির ব্যবসার হাল ধরেছেন তাঁর সন্তানেরা। জলযোগ মিষ্টি ঘরকে ঘিরে বাবার সুনাম, মিষ্টির সুনাম এখনো ধরে রেখেছেন তাঁরা।
অখিল রঞ্জন দাশের এক ছেলে অসীম কুমার দাশ, যিনি জলযোগের দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর আগে বাবা এসে এখানে (মুরইছড়া বাজারে) ব্যবসা শুরু করেন। বাবার সময় থেকেই মিষ্টির সুনাম। মানুষ আমাদের মিষ্টি ভালো পায়। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসে মিষ্টি খান, নিয়েও যান। উপজেলা, জেলা, এমনকি বিভাগীয় পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের মিষ্টি নিয়ে থাকেন। প্রবাসীরা দেশ থেকে যাওয়ার সময় আমাদের দোকানের মিষ্টি নিয়ে যান।’
অসীম কুমার দাশ বলেন, ‘দোকানের শুরু থেকেই খাঁটি ছানা দিয়ে আমাদের মিষ্টি তৈরি হচ্ছে। আমরা মিষ্টির মান কখনো নষ্ট করিনি। এখন দুধের অনেক দাম। বাইরে থেকে দুধ আনতে হয়, তা–ও মান ধরে রাখার চেষ্টা করি। আমাদের মিষ্টি পুরোটাই ছানার তৈরি।’ জানালেন, তাঁদের বাড়ি পাশের ইউনিয়ন পৃথিমপাশার রবিরবাজারে। এ বাজার থেকে প্রতিদিন তাঁরা মুরইছড়া বাজারে আসা–যাওয়া করেন।
অসীম কুমার দাশ বলেন, শুরুর দিকে দোকানের মিষ্টির অতোটা প্রচার ছিল না। গ্রামের বাজার। যোগাযোগও অতো উন্নত ছিল না। এখনকার মতো পাকা সড়ক ছিল না। আশপাশের মানুষই ছিলেন এই মিষ্টির ক্রেতা। ২০-২৫ বছর ধরে জলযোগের মিষ্টির পরিচিতি বেড়েছে। গ্রামের ছোট একটি বাজার থেকে উপজেলা শহরসহ বিভিন্নজনের কাছে এই মিষ্টির সুনাম ছড়িয়েছে। কুলাউড়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পড়েছে হাটটি। অনেকটাই উঁচু–নিচু টিলার পথ বেয়ে বাজারে যেতে হয়। তাঁদের দোকানের তৈরি বিশেষ মিষ্টির মধ্যে আছে সাদা স্পঞ্জ মিষ্টি, কালোজাম ও লালমোহন। এই তিনটি মিষ্টিই বেশি চলে। তাঁদের তৈরি স্পেশাল নিমকিরও আলাদা সুনাম আছে।
জলযোগ মিষ্টি ঘরের তৈরি প্রতি কেজি স্পঞ্জ মিষ্টি ২৮০ টাকা, কালোজাম ও লালমোহন ২৪০ টাকা, স্পেশাল নিমকি ২০০ টাকা ও কাটাগজা ১৮০ টাকা। গ্রামের বাজার হলেও প্রতিদিন তাঁদের এখানে ২০ থেকে ৩০ কেজি মিষ্টি বিক্রি হয়।
জলযোগের মিষ্টির কদর যে আছে, তা টের পাওয়া যায় মৌলভীবাজার জেলা সদরের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠক আহমদ আফরোজের কথায়। মঙ্গলবার এই দোকানে মিষ্টি খাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘এখানে (জলযোগে) এসে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো। ভালো একটা মিষ্টি খেলাম।’ তাঁকে তাঁর পরিচিত কয়েকজন ওই দোকানের মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য নিয়ে এসেছিলেন।
মুরইছড়া বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী হারিছ আলী বলেন, জলযোগের মিষ্টির সুনাম আছে। তাঁরা নিজেরাই এই মিষ্টি তৈরি করেন। শুধু স্থানীয়ভাবেই এর পরিচিতি নয়, কুলাউড়া-মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ তাঁদের মিষ্টি নিতে আসেন। অনেক জায়গার মানুষ এসে দোকানে মিষ্টি খেয়ে যান।