৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে রোববার মধ্যরাতে। আবার সাগরে যেতে প্রস্তুত হচ্ছে উপকূলের জেলেরা। রোববার সকালে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর সদর ইউনিয়নের বুড়াগৌরাঙ্গ নদের মোহনা সামুদাবাদ গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা রোববার মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে। এখন ট্রলার নিয়ে সাগরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন উপকূলের জেলেরা। জেলেরা বলছেন, তাঁরা অভাব-অনটনের মধ্যেও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে মাছ ধরেন না। অথচ ভারতের জেলেরা তখন বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যান। তাই তাঁরা ভারতের সঙ্গে একই সময়ে বঙ্গোপসাগরে নিষেধাজ্ঞার দেওয়ার দাবি জানান।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মাছের বংশবিস্তারের জন্য বঙ্গোপসাগরে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। বাংলাদেশের জলসীমায় এই নিষেধাজ্ঞা থাকে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন। আর ভারতের জলসীমায় তা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন (৬১ দিন)।

জেলেদের অভিযোগ, বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার মধ্যে প্রায় ৩৯ দিন ভারতীয় জেলেরা দেদার বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ দেশের লাখ লাখ জেলে এবং মাছের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে বলেন, ‘পেটে পাথর বেঁধে আমরা মাছ ধরায় বিরত থাকি। আর আমাদের পাশের দেশের জেলেরা আমাদের সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে না হয় জেলেদের লাভ, না বাড়ে মাছের উৎপাদন। আমরা কষ্ট করতে প্রস্তুত আছি, যদি তাতে দেশের ভালো হয়। কিন্তু এতে তো ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হচ্ছে না। দুই দেশে মাছ ধরা বন্ধের একই সময় থাকলে ভালো হবে।’

চাঁদপুরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান আজ রোববার দুপুরে বলেন, মৎস্যজীবীদের দাবিটি যৌক্তিক। বিষয়টি কয়েকটি কারিগরি সভায় তাঁরা উত্থাপন করেছেন। এ জন্য পদক্ষেপ নিতে হলে দুই দেশের কারিগরি পর্যায়ে একটি বৈঠক হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাঁরা ভারতের কর্মকর্তা ও গবেষকদের আমন্ত্রণ জানাতে পারেন।

মৎস্য বিভাগ সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের ছয়টি মৎস্যজীবী সংগঠন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ২০১৮ সালের ৮ মে দুই দেশের জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল। বাংলাদেশের পক্ষে যে তিনটি সংগঠন ওই স্মারকে স্বাক্ষর করে এর মধ্যে চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিংবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন একটি।

মৎস্যজীবীদের দাবিটি যৌক্তিক। বিষয়টি কয়েকটি কারিগরি সভায় তাঁরা উত্থাপন করেছেন। এ জন্য পদক্ষেপ নিতে হলে দুই দেশের কারিগরি পর্যায়ে একটি বৈঠক হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাঁরা ভারতের কর্মকর্তা ও গবেষকদের আমন্ত্রণ জানাতে পারেন।
মো. আনিসুর রহমান, চাঁদপুরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

সংগঠনটির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক গতকাল দুপুরে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়টি (নিষেধাজ্ঞার সময়) নিয়ে আমাদের মৎস্য বিভাগ এবং ভারতের মৎস্যজীবী সংগঠনের মধ্যে আলোচনা করেছি। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা আমাদের দাবির প্রতি একমত। এখন দুই দেশের একটি যৌথ আলোচনা আয়োজন করে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা একই সময়ে নির্ধারণে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’

শাহ আলম মল্লিক আরও বলেন, বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে প্রায় ৩৯ দিন ভারতীয় জেলেরা মাছ এ দেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরে। একই জায়গার এপার-ওপার ভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা দিলে এতে কী লাভ হয়? এটা একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা দিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাচ্ছেন।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার দাবি করে আসছি। গরিব জেলেরা সাগরে নামতে না পারলে খাবেন কী? তাই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে অনেক জেলে জেল-জরিমানার ভয় উপেক্ষা করেন। তবে বেশির ভাগ জেলে ও ট্রলারমালিক আইন মেনে সাগরে যান না। কিন্তু তাতে আমাদের কোনো লাভ হয় না বরং ক্ষতি হচ্ছে।’

সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জেলেরা। পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটে রোববার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

অভাবে জর্জরিত জেলে পরিবার

এদিকে নিষেধাজ্ঞার ৬৫ দিনে বেকার হয়ে পড়েন উপকূলের কয়েক লাখ জেলে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁদের মানবেতর দিন কাটে। জেলেরা বলেন, সরকার এই সময়ে জেলেদের ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় চাল সহায়তা দিয়েছে। তবে তা অপ্রতুল।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মা ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ-এপ্রিলের দুই মাসের অভয়ারণ্যের নিষেধাজ্ঞা এবং সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে বছরে ১৪৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা পালন করতে হয় তাঁদের। এমনিতেই করোনাকালে দুই বছরে জেলেদের রোজগার হয়নি। অনেকে ঋণ আর ধার-দেনায় জর্জরিত।

মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, সরকার এই নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের খাদ্যসহায়তা দেয়। বরিশাল বিভাগে নিবন্ধিত জেলে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯১ জন। এর মধ্যে মধ্যে ভিজিএফ সহায়তা দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৯ জন জেলেকে। এই জেলেরা প্রত্যেকে ৮৬ কেজি চাল সহায়তা পাচ্ছেন। এর মধ্যে প্রথম কিস্তিতে ৫৬ কেজি চাল পেয়েছেন। দ্বিতীয় কিস্তিতে আরও ৩০ কেজি চাল সহায়তা পাবেন। তবে নিবন্ধিত অনেক জেলে এ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

জেলেরা বলেন, সরকারের কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে এক মাসের খোরাকিও হয় না। ফলে সীমাহীন কষ্ট পরিবার নিয়ে দিন কাটতে হয় এ সময়ে। এমনিতেই করোনার সময় তাঁরা অনেক ধার-দেনা করেছেন। তার ওপরে নিষেধাজ্ঞার ধকল তাঁদের জীবনকে আরও গভীর খাদে ফেলেছে।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানি এলাকার জেলে মাসুম মিয়া বলেন, ‘যে চাল সরকার দেয়, হ্যাতে এক মাসের বেশি খোড়াইক অয় না। হ্যারপর বাজার-সদাই, পরিবারের অন্য খরচ আইবে কোমনে গোনে। অন্য কোনো কামও তো পারি না যে করমু। হেইতে ধারদেনা কইর্যাদ এই দিনগুলা পার করছি। বছর ভচর খালি দেনার বোঝা বাড়তেই লাগছে।’

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, প্রতিবছরই সরকার সহায়তার পরিমাণ বাড়াচ্ছে। আর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নানা প্রক্রিয়া চলছে।