কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচন সোমবার, মূল লড়াই মাসেদুল-মাহাবুবুরের মধ্যে

মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী ও মাসেদুল হক
ছবি: সংগৃহীত

বহুপ্রত্যাশিত কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে সোমবার (১২ জুন)। ভোট গ্রহণ হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। এ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দলীয় মেয়র প্রার্থী নেই। মাঠে থাকা পাঁচ মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত) মাসেদুল হক ওরফে রাশেদের মধ্যে মূল লড়াই হবে বলে ভোটারদের ধারণা।

ভোটারদের ভাষ্য, জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ভোটাররা নৌকার পক্ষে থাকলেও বিএনপির ভোট মাসেদুল হকের দিকে (নারকেলগাছ প্রতীক) ঝুঁকতে পারে। মূলত বিএনপির ভোটে মেয়রের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

পৌরসভার ৯৫ হাজার ভোটারের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের ৩৫ হাজার ভোট রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই মেয়র প্রার্থীর জয়-পরাজয় নিয়ে ফেসবুকে ভোটাররা নানা মন্তব্য পোস্ট করছেন। কেউ বলছেন, বিপুল ভোটে নৌকা জিতবে। আবার কারও বক্তব্য, নারকেলগাছ প্রতীকে ভোট দিয়ে ভোটাররা সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাবে। প্রধান দুই মেয়র প্রার্থীকে সমর্থন জানানো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানও পরিষ্কার।

নির্বাচনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শহরের টেকপাড়ার ভোটার জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি ও কক্সবাজার আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ তাঁর ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনে আরামে আছে জামায়াত, ঠেলাঠেলিতে আওয়ামী লীগ, অতি কষ্টে বিএনপি, মজা নিচ্ছে জাতীয় পার্টি, সবচেয়ে সুবিধায় জাসদ। একটু কষ্টে কমিউনিস্ট পার্টি। প্রায় ভোটার দোদুল্যমান।’

ভোটাররা বলছেন, লড়াইটা হচ্ছে নৌকা সঙ্গে নারকেলগাছের। বিএনপির ভোট যদি নারকেলগাছে পড়ে, সে ক্ষেত্রে নৌকার জয়লাভের হিসাবে গরমিল দেখা দিতে পারে। বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পৌর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না। তাই বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী ও সমর্থক ভোট দিতে কেন্দ্রেও যাবে না।’

কক্সবাজার শহরের বিএনপি নিয়ন্ত্রণ করেন কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় বিএনপির মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক লুৎফর রহমান কাজল। কয়েক দিন ধরে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। রোববার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না।
দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেওয়ায় ১২ জন বিএনপি নেতাকে কেন্দ্র থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃত কাউন্সিল প্রার্থীরা জয়লাভের জন্য দলের কর্মী-সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে মরিয়া। এদিকে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারকেলগাছ প্রতীকের পক্ষে প্রচারে অংশ নেওয়ায় সম্প্রতি শহর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ১৩ জন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

নির্বাচনে মেয়র পদে ৫ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৫৮ জন ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। স্বতন্ত্র অপর তিন মেয়র প্রার্থী হলেন জগদীশ বড়ুয়া (হেলমেট প্রতীক), জোসনা হক (মোবাইল ফোন প্রতীক) ও মো. জাহেদুর রহমান (হাতপাখা প্রতীক)। জোসনা হক শুরু থেকে নিজের প্রতীক বাদ দিয়ে তাঁর স্বামী মাসেদুল হকের নারকেলগাছের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন।

ভোটাররা জানান, পৌরসভার ১, ২, ৮ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকা প্রতীকের ভোট বেশি। এসব ওয়ার্ডে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটার ১৩ হাজার। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী প্রকাশ্য ও গোপনে নারকেলগাছের পক্ষে মাঠে নামায় নৌকার সমর্থক ভোটারদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

পৌরসভার বর্তমান মেয়র মুজিবুর রহমান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি নৌকা প্রতীকের পক্ষে শুরু থেকে সক্রিয় ছিলেন। চাচাতো ভাই হলেও মাসেদুলের সঙ্গে মুজিবুরের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বাড়ির পাশের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাতটি কেন্দ্রের ২০ হাজার ভোট ভাগাভাগি নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মর্যাদার লড়াই চলছে। এসব কেন্দ্র থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট নৌকায় না পড়লে নৌকার সহজ জয়ের পথ রুদ্ধ হতে পারে।

এ বিষয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটারদের ৯৮ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা মাথা গোঁজার ঠাঁই আর নিরাপত্তা চান। প্রধানমন্ত্রী পাঁচ হাজার শ্রমজীবী পরিবারের জন্য খুরুশকুলে পাঁচতলা ভবনের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করছেন। ইতিমধ্যে পাঁচতলা ২০টি ভবনে ৬০০ পরিবারের ঠাঁই হয়েছে। অন্যদের জন্যও ভবন নির্মাণ করছে সেনাবাহিনী। সুতরাং ভোটারদের রায় নৌকার পক্ষেই যাবে।

শুরু থেকে মাসেদুল হকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন তাঁর দুই ছোট ভাই, এক বোন ও তিন ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানেরা। অন্যদিকে মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী নৌকার পক্ষে মাঠে গণসংযোগ ও নির্বাচনী প্রচার অংশ নেন শহর ও জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এরপরও জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হতে পারছেন না আওয়ামী লীগ নেতারা। তাঁদের ভয় বিএনপির ভোট।

মাসেদুল হক কালোটাকায় ভোটারদের প্রভাবিত করছেন—এমন অভিযোগ শুরু থেকেই করে আসছেন মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ১০ বছর আগেও মাসেদুলের কী ছিল? দখলবাজ, চাঁদাবাজি, সুদের ব্যবসা করে এখন শতকোটি টাকার মালিক। সেই কালোটাকা এখন নির্বাচনে ছিটানো হচ্ছে, ভোট কেনা হচ্ছে।

মাসেদুল হকও নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে মাহাবুবুর রহমান চৌধুরীকে ‘বহিরাগত’ উল্লেখ করে ভোট টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাসেদুল বলেন, শহরে কী যোগ্য লোকের অভাব ছিল যে মাহাবুবের মতো ‘বহিরাগত’ একজন লোককে আওয়ামী লীগের মতো দলের মেয়র প্রার্থী করতে হবে?

মাসেদুল নির্বাচনী প্রচারে তাঁর প্রয়াত বাবার রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ তুলে ধরেন। তাঁর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মোজাম্মেল হক কক্সবাজার পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় সম্প্রতি মাসেদুল হককে আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এরপর পথসভাগুলোতে নিজেকে নির্দলীয় প্রার্থী দাবি করে মাসেদুল হক বলেন, বিএনপি-জামায়াতসহ সব দলের লোকজন তাঁর পক্ষে রয়েছেন। বিপুল ভোটে নারকেলগাছ জয়লাভ করবে।