মৌলভীবাজারে শত বছরের পুরোনো হাটে কাঁঠালের ম–ম ঘ্রাণ

বিক্রির জন্য স্তূপ করে রাখা কাঁঠাল। সোমবার সকালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজারে
ছবি: প্রথম আলো

সড়কের দুই পাশে ছড়ানো-ছিটানো ছোট-বড় কাঁঠালের স্তূপ। বিক্রির জন্য কেউ কাঁঠাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ গাড়িতে করে কাঁঠাল নিয়ে এসে স্তূপ সাজাচ্ছেন। কেউ গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন কাঁঠাল। পুরো হাটজুড়ে হাওয়ায় ভাসছে পাকা কাঁঠালের ম-ম ঘ্রাণ। মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কে কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজারে সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার বসে কাঁঠালের হাট। ভোরের আলো ফোটার মুহূর্ত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেচাকেনা চলে।

গতকাল সোমবার সকালে ব্রাহ্মণবাজার হাটে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের বিভিন্ন দিকের সড়ক দিয়ে হাটে কাঁঠাল নিয়ে আসছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। কেউ বাইসাইকেলে, কেউ ঠেলাগাড়িতে, কেউ সিএনজিচালিত অটোরিকশায়, কেউ পিকআপ ভ্যানে করে কাঁঠাল নিয়ে হাটে আসছেন। ব্রাহ্মণবাজারের পূর্ব দিকের ব্রিজ থেকে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের প্রায় আধা কিলোমিটারের দুই পাশে কাঁঠাল নিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা।

পাইকারেরা আসছেন, দরদাম করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার কথাবার্তায় গমগম করছে স্থানটি। এই ক্রেতাদের মধ্যে পাইকার ও খুচরা ক্রেতা উভয়েই আছেন। দাম ঠিক হলে যার যার মতো করে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন কাঁঠাল। কাঁঠালের একটা স্তূপ খালি হলে অন্য কেউ সেখানে আবার কাঁঠাল নিয়ে বসছেন। ক্রেতা-বিক্রেতা আর শ্রমিকের হট্টগোলে সরগরম পুরো এলাকা।

কাঁঠাল নিয়ে প্রায় সাত কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন উপজেলার হাজীপুরের আলকাছ মিয়া। তাঁর নিজের গাছের কাঁঠাল। তাঁর ১২টি কাঁঠালের দাম ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরম বেশি থাকায় গত হাটগুলোতে কাঁঠালের দাম মেলেনি। গত হাটে ১২টি কাঁঠালের দাম উঠেছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।’

মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কে কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজারে সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার বসে কাঁঠালের হাট
ছবি: প্রথম আলো

একই রকম বাইসাইকেলে করে কাঁঠাল নিয়ে আসা দড়িতাজপুরের কয়ছর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দামের কোনো স্টেশন নাই। যে যত বেচতে পারে।’ তিনি জানান, তাঁর বাড়িতে চার-পাঁচটি গাছ আছে। তিনি ১১টি কাঁঠালের দাম চাইছেন ১ হাজার টাকা। দাম হচ্ছে ৫০০ টাকা।

হাটে আসা কৃষকদের কাছ থেকে কাঁঠাল কিনে পাইকারের কাছে বিক্রি করেন গণি মিয়া। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি মৌসুমি এই ব্যবসা করেন। প্রতি হাটবারে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাভ থাকে তাঁর।

আবদুল বাছিত এসেছেন সিলেটের গোয়ালাবাজার থেকে। তিনি সাড়ে ৭ হাজার টাকায় ১১০টি কাঁঠাল কিনেছেন। একসঙ্গে অন্য পাইকারের সঙ্গে একই গাড়িতে করে কাঁঠাল নেবেন। তাঁর কাঁঠাল যাতে অন্য পাইকারের কাঁঠালের সঙ্গে মিশে না যায়, এ জন্য প্রতিটি কাঁঠালে সবুজ রঙের চিহ্ন এঁকে পৃথক করছিলেন।

ক্রেতা-বিক্রেতা আর শ্রমিকের হট্টগোলে সরগরম পুরো হাট এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

সড়কের পাশে ৪৫টি কাঁঠাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শরীফ মিয়া বলেন, ‘হিংগাজিয়ায় ৫০ হাজার টাকা দিয়া ফসল (কাঁঠাল) আওয়ার (আসর) পর ৪০০ গাছ রাখছি। কিন্তু এবার ফায়দা অইছে না (লাভ হয়নি)। খরায় মারছে (ক্ষতি করছে)। দাম মোটামুটি ভালা। তবে বিক্রি ভাগ্যের ওপরে। ৪৫টা কাঁঠাল চাইর (চার) সাড়ে চাইর হাজার টাকা দাম ওর (হচ্ছে)।’ তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার টাকার কাঁঠাল বিক্রি করেছেন। গাছে আরও ২০০-২৫০ কাঁঠাল আছে।

বালাগঞ্জের ব্যবসায়ী আনকার আলী ২০০ কাঁঠাল কিনেছেন ১৪ হাজার টাকায়। প্রতি হাটবারেই তিনি কাঁঠাল কিনতে ব্রাহ্মণবাজারে আসেন। এবার প্রথম এই হাটে এসেছেন শ্রীমঙ্গলের শমসেরগঞ্জের পীযূষ চন্দ্র দাস। তিনি এই হাট থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় ৫০টা কাঁঠাল কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে বেচতে পারলে বেচমু (বিক্রি করব), নাইলে অন্তেহরি (রাজনগরের একটি বাজার) নিয়া বেচমু।’

ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় শত বছরের পুরোনো ব্রাহ্মণবাজারে কাঁঠালের মৌসুমে ভিন্ন আমেজ তৈরি হয়। কুলাউড়ার পৃথিমপাশা, কর্মধা, বুধপাশা, টিলাগাঁও, হাজীপুর, লংলা, তারাপাশা, সিরাজনগর, রাজনগরের টেংরাসহ আশপাশের বিভিন্ন টিলা ও চা-বাগান থেকে এখানে কাঁঠাল আসে। স্বাদ ও ঘ্রাণের জন্য বুধপাশার কাঁঠালের বিশেষ চাহিদা আছে। এই কাঁঠাল বিক্রির আয় দিয়েই কারও কারও সারা বছরের খরচাপাতি চলে। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, তাজপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ, নবীগঞ্জ, শেরপুর, গোয়ালাবাজার, বিশ্বনাথসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারেরা এসে কাঁঠাল নিয়ে যান। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই মৌসুমি কাঁঠালের হাট শুরু হয়, চলে শ্রাবণের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

প্রতি হাটবারে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার কাঁঠাল বিক্রি হয় এখানে
ছবি: প্রথম আলো

হাটের তোলা আদায়কারী মো. শাহাবুদ্দিন ফারুক বলেন, ‘প্রতি হাটবারে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার কাঁঠাল বিক্রি হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক পাইকার আসেন। খুচরা ক্রেতাও থাকেন কয়েক শ।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সারা জেলার ২৮৮ হেক্টরে কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে। কাঁঠাল মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে খরার কারণে কাঁঠালের আকার ছোট হয়েছে। মৌলভীবাজারের কাঁঠাল ছোট হলেও ঘ্রাণ ও স্বাদটা ভালো।’