টর্চার সেল থেকে বেঁচে ফেরা এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মর্মবেদনা
‘যে চেতনা নিয়ে দেশকে মুক্ত করার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের সেই সুচেতনা, সেই স্বপ্ন অনেকটা ধূসর, বিবর্ণ। ৫২ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু চেতনা, দেশপ্রেমের এতটা বিস্মরণ হয়েছে যে এখন আমাদের আত্মত্যাগে অর্জিত এই দেশ নিয়ে কেউ যেন ভাবতেই চান না। নিজেকে নিয়ে ভাবতে বেশি মনোযোগী সবাই। না হলে এ দেশ থেকে কীভাবে অর্থ লুট করে বিদেশে পাচার হয়? কেন এখনো কিছু মানুষের কাছে এত বেশি অর্থসম্পদ আর অধিকাংশ মানুষ নিঃস্ব?’
বরিশালের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবির ভুলু ২০ মার্চ রাতে এভাবেই নিজের আক্ষেপের কথা প্রথম আলোর কাছে বর্ণনা করছিলেন। বরিশাল নগরের ওয়াপদা কলোনি ছিল পাকিস্তানি সেনাদের টর্চার সেল। সেখান থেকে যাঁরা প্রাণ নিয়ে ফেরেন, তাঁদের একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবির ভুলু। ১৯ দিন অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পরে কারাগারে কাটান আরও ৭১ দিন। এরপর মুক্তি পেয়ে আবার রণাঙ্গণে ফেরেন লড়াকু এই সৈনিক।
সুশান্ত ঘোষের মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের কিশোর ইতিহাস, এশিয়াটিক সোসাইটির মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, সুকুমার বিশ্বাসের মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল ও একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবরসহ বিভিন্ন বইয়ে বরিশালের ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। এসব বইয়ের তথ্য বলছে, হানাদার বাহিনী বরিশালে প্রবেশ করে ২৫ এপ্রিল। স্টিমারঘাট, বিসিক ও চরবাড়িয়া এলাকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে তারা। পথে নির্বিচার হত্যা করে বাঙালিদের। ২৯ এপ্রিল পাকিস্তানিরা পাউবোর ওয়াপদা কলোনি দখল করে এবং অপেক্ষাকৃত নির্জন এই এলাকাকে ক্যাম্প স্থাপনের জন্য বেছে নেয়। এখান থেকেই ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলায় অভিযান চালাত হানাদাররা। ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে সাগরদী খালের তীরে বাংকার তৈরি করে সশস্ত্র পাহারা বসানো হয়। ওয়াপদা কলোনিতে ক্যাম্পের পাশাপাশি একাধিক ভবনে টর্চার সেল স্থাপন করে হানাদাররা। ২৫ নম্বর ভবনে অসংখ্য বাঙালি মুক্তিকামী নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। প্রতিদিন ট্রাকে করে বাঙালিদের ধরে আনা হতো টর্চার সেলে। ভোররাতে তাঁদের পাশের সাগরদী খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে মেরে মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হতো।
ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা কবির ভুলুকে। সেই দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেন তিনি প্রথম আলোর কাছে।
একাত্তরের ১৬ জুলাই। সকালে আগৈলঝাড়ার গ্রামের বাড়ি থেকে একটি স্টেনগান, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ নৌকায় ওঠেন ভুলু। সঙ্গে ছিলেন সহযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আর নৌকার মাঝি মেহের আলী। গন্তব্য ছিল বরিশাল সদরের চর কমিশনার। পথে গৌরনদীর বাটাজোর খালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন তাঁরা। নৌকা থেকে তুলে পিঠমোড়া করে খালের কিনারে তোলা হয় তিনজনকে। ওই দিন তাঁদের রাখা হয় গৌরনদী কলেজের সেনা ক্যাম্পে। সেখান থেকে প্রথমে বাটাজোর সেনা ক্যাম্প ও পরে বরিশালের ওয়াপদা কলোনি। টর্চার সেলে টানা ১৯ দিন তাঁদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন।
কবির ভুলু বলেন, প্রতিদিনই চলত সীমাহীন নির্যাতন। বেয়োনেট দিয়ে তাঁদের শরীর খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হতো। পিঠমোড়া করে বেঁধে যতক্ষণ জ্ঞান থাকত, ততক্ষণ চলত নির্যাতন। সহযোদ্ধা আনোয়ার ছিলেন সুঠাম দেহের। একদিন ভোররাতে তাঁকে কক্ষ থেকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। আনোয়ার হাঁটতে পারছিলেন না। তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। তারপর গুলির শব্দ। এরপর আর আনোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছুদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয় নৌকার মাঝি মেহেরকে।
কবির ভুলু বলেন, ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে ১৯ দিন রাখার পর তাঁকে নেওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। নেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২১ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ছাড়া পেয়ে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া ক্যাম্পে যান। আবার যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। পরে মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাটে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কারফিউ দিলে লঞ্চে করে বরিশাল ত্যাগ করেন। ওই দিন মুক্তিযোদ্ধারা নগরে প্রবেশ করেন। এরপর মুক্ত হয় বরিশাল।
জীবনসায়াহ্নে এসে কবির ভুলু এখনো হাতড়ে বেড়ান সেই সব স্বপ্ন আর স্মৃতি। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কখনো তিনি হতাশায় মুষড়ে পড়েন। আবার যুদ্ধদিনের বীরত্বের স্মৃতির কথা বলতেই সাহসী হয়ে ওঠে তাঁর চোখ। ‘নিজেকে খুব অপমানিত লাগে যখন দেখি, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধার নাম ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব করবে, সেটা কোনো দিন ভাবতেও পারিনি। এটা আমাদের জন্য অবমাননাকর, লজ্জার। নতুন প্রজন্ম এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে একটি নেতিবাচক বার্তা পাচ্ছে,’ বলে আফসোস ঝরে বীর এই মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠে।