চরের কৃষিকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্ন নিয়ে চাষাবাদে কলেজশিক্ষক টিটুল
মাঘের তীব্র শীতে কাদাপানির মধ্যে দাঁড়িয়ে কোদাল হাতে বোরোধানের জমি প্রস্তুত করছেন এক যুবক। দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনিই বই হাতে নিয়ে কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান। এমন এক কৃষি উদ্যোক্তাকে পাওয়া গেল শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পদ্মা নদীর চরাঞ্চল নওপাড়া এলাকায়। যিনি কলেজে পাঠদানের পরের সময়টুকুতে চাষাবাদ করে ফসল ফলান।
টিটুল খালাসি নামের এই যুবক নড়িয়ার চরআত্রা আজিজিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের প্রভাষক। ধান, শর্ষে, মরিচ, শাক-সবজি আবাদের পাশাপাশি গরুর খামার করে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। নতুন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে লাভের মুখও দেখেছেন। স্থানীয় কৃষকদের আধুনিক কৃষিকাজ, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন ও গরুর খামার ব্যবস্থাপনার ওপর পরামর্শ দিয়ে জনপ্রিয় হচ্ছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষিকাজে নেমে টিটুল অনেকের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন বলে জানালেন নওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন মুন্সি। তিনি বলেন, সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ আসার পর কৃষির উৎপাদন বেড়েছে। বিদ্যুতের সুবিধা পাওয়ার কারণে কলেজশিক্ষক কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। তাঁকে দেখে অনেক যুবক গরুর খামার ও চাষাবাদ করছেন। এভাবে শিক্ষিত লোকজন ফসল উৎপাদনে যুক্ত হলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।
টিটুল খালাসি (৩৫) ফরিদপুরের সালথা উপজেলার সিংহপ্রতাপ গ্রামের মৃত আরমান খালাসির ছেলে। কৃষক পরিবারের সন্তান টিটুল ২০১২ সালে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে স্নাতকত্তোর পাস করেন। এরপর আইন বিষয়ের ওপর স্নাতকত্তোর ডিগ্রিও অর্জন করেন। জীবিকার জন্য ঢাকায় বেসরকারি কোম্পানির চাকরিতে যুক্ত হন। ২০১৯ সালে চরআত্রা আজিজিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান।
চার দিক দিয়ে পদ্মা নদীবেষ্টিত নওপাড়া চরের সম্ভবনা দেখে কৃষি ও গবাদি পশুর খামার করার চিন্তা করেন টিটুল। ২০২০ সালে পাঁচটি গরু নিয়ে খামার শুরু করেন। পর পর দুটি ঈদুল আজহায় গরু বিক্রি করে ২ লাখ টাকা লাভ করেন। এর পর শ্বশুরের এক একর জমি ও আরও ছয় একর জমি ভাড়া নিয়ে বোরো ধান, শর্ষে, মরিচ ও শাক-সবজির আবাদ শুরু করেন ২০২২ সালে।
গত শুক্রবার দুপুরে নওপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খেতে কাজ করছেন কলেজশিক্ষক টিটুল। পানি দিয়ে জমি ভেজানোর পর তা কোদাল দিয়ে প্রস্তুত করছেন। পাশের জমিতে কৃষি শ্রমিকেরা ধানের চারা রোপণ করছেন। কেউ কেউ ট্রাক্টর দিয়ে জমি প্রস্তুত করছেন।
এ অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষেরা সরাসরি কৃষিকাজ করেন না। আমাদের কলেজের প্রভাষক টিটুল নিজেই জমিতে কাজ করেন, ফসল ফলান। এটা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।
শুক্রবার ও শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ওই দুই দিন ও প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত কৃষি জমি ও গরুর খামারে কাজ করেন টিটুল। স্ত্রী তাহমিনা আক্তার পাশের নওপাড়া মুন্সি আজিজুল হক উচ্চবিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করেন। তিনিও স্বামীর কৃষি ও গরুর খামারে অবসর সময়ে কাজ করেন।
টিটুল খালাসি প্রথম আলোকে বলেন, এটা কৃষি অঞ্চল। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় কৃষিতে তেমন সফলতা নেই। সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আনা হয়েছে চরে। এখন কৃষিকে সমৃদ্ধ করার সময় এসেছে। তাই অবসর সময় নষ্ট না করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছেন। এ অঞ্চলের কৃষকেরা অনেক বিষয় বোঝেন না। তাঁদের নানা বিষয়ে পরামর্শ দেন।
স্বামীর এমন কর্মকাণ্ডে আনন্দিত তাহমিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমিও তাকে এ কাজে সহায়তা করছি। আমাদের দেখে এলাকার মানুষ উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। অনেকে আমাদের প্রশংসা করেন। তখন অনেক আনন্দ লাগে।’
টিটুল খালাসিকে সবার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবেই দেখছেন চরআত্রা আজিজিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এ অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষেরা সরাসরি কৃষিকাজ করেন না। আমাদের কলেজের প্রভাষক টিটুল নিজেই জমিতে কাজ করেন, ফসল ফলান। এটা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি চরের জনপদে ফসল আবাদে আশার আলো দেখাচ্ছেন।’
জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চরআত্রায় এক কলেজশিক্ষক অবসর সময়ে নিজে চাষাবাদ করেন এটা ভালো খবর। এতে মানুষ উদ্বুদ্ধ হবেন। কৃষিপণ্য উৎপাদনে আরও মনোযোগী হবেন।
গরুর খামার থেকে লাভবান হচ্ছেন টিটুল খালাসি। তবে কৃষি ফসলে গত বছর লাভ-লোকসান কোনটিই হয়নি। এ বছর লাভের আশাবাদ জানিয়ে টিটুল বলেন, ‘করোনা ও সাম্প্রতিক ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’