যশোরে কিশোরী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, দম্পতি কারাগারে

গৃহকর্মী মেয়েটির পায়ে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন। পান থেকে চুন খসলেই তার ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়্গ। বৃহস্পতিবার যশোর জেনারেল হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

যশোরে কিশোরী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ওই কিশোরীর মা বাদী হয়ে দুজনকে আসামি করে মামলাটি করেছেন। যশোর কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল আলম চৌধুরী বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।

মামলার আসামিরা হলেন অভিযুক্ত গৃহকর্তা সরকার শামীম আহমেদ ওরফে অংকু (৩২) ও তাঁর স্ত্রী জিন্নাত রেহেনা ওরফে জুঁই (২৭)। তাঁদের গতকাল আদালতের মাধ্যমে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শামীম একটি কীটনাশক কোম্পানির বিক্রয় ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া সড়কে ওই দম্পতির বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করত নির্যাতনের শিকার মেয়েটি।

এ বিষয়ে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ওই কিশোরীর ওপর নির্যাতনের অভিযোগে শিশু নির্যাতন আইনে দুজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তবে ওই শিশুর পরিবারের স্বজনেরা থানায় আসতে দেরি করায় মামলা হওয়ার আগেই অভিযুক্ত দুজনকে গতকাল বিকেলে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হয়েছে। পরে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আরও পড়ুন

এর আগে গত বুধবার দিবাগত রাত একটার দিকে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল পেয়ে যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া সড়কের ব্যাংকপাড়ার একটি বাসা থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। পরে তাঁকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরীর বাড়ি দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায়। বুধবার ওই কিশোরীকে উদ্ধারের পাশাপাশি ওই দিন শামীম আহমেদ ও তাঁর স্ত্রীকে আটক করে পুলিশ।

হাসপাতালে কাতরাচ্ছে কিশোরী

যশোর জেনারেল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ওই কিশোরী। তবে আর্থিক টানাপোড়েনে মেয়ের চিকিৎসার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ওই কিশোরীর মা।

আজ শুক্রবার দুপুরে কিশোরীর মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ের একটি পা ও একটি চোখ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। পা ভেঙেছে কি না, তা দেখার জন্য হাসপাতালের ডাক্তার এক্স–রে করতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমে যাওয়ায় অন্যান্য পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে বলেছে। কিন্তু আমাদের কাছে তো থাকা–খাওয়ার খরচের টাকাই নেই। মেয়ের চিকিৎসা করাব কীভাবে?’

তবে যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপপরিচালক) হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই কিশোরীর পরীক্ষা–নিরীক্ষাসহ চিকিৎসার যাবতীয় খরচ হাসপাতাল থেকে বহন করা হবে। তার স্বজনদের কোনো টাকা খরচ করা লাগবে না।

কিশোরীর শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়েটিকে দীর্ঘদিন ধরে ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে পেটানোর কারণে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমে রয়েছে। ওই স্থানে সার্জারি করা লাগতে পারে। এ ছাড়া পা দুটো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্স–রে, রক্তসহ অন্যান্য পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন তার শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন হবে।’

নির্যাতনকারীদের বিষয়ে ওই কিশোরীর মা বলেন, ‘নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করার জন্য আমার মেয়েটিকে তারা (শামীম ও তাঁর স্ত্রী) নিয়েছিল। প্রথমে তারা রংপুরে ছিল। হঠাৎ তারা আমাকে কিছু না জানিয়ে ৯ মাস আগে রংপুর ছেড়ে চলে যায়। আমি ফোন করলে তারা ফোন ধরে না। দুই–একবার ফোন ধরলেও মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দিত না। তাদের ঠিকানা চেয়েও পাইনি। তারা নির্যাতন করে আমার মেয়েটার সর্বনাশ করেছে। আমি ওই দুজনের ফাঁসি চাই।’

ওই দম্পতি ৯ মাস ধরে তাকে নির্যাতন করে আসছেন বলে অভিযোগ করেছিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই কিশোরী। গতকাল সে প্রথম আলোকে বলে, তাকে সময় ধরে ঘরের সব কাজ করতে হতো। কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, থালাবাসন পরিষ্কার, মসলা বাটাসহ সব কাজ। কোনো কাজে একটু সময় বেশি লাগলে রুটি বানানোর ব্যালন, ডিশ লাইনের তার আর সেলাই রেঞ্জ দিয়ে নির্যাতন করতেন গৃহকর্ত্রী জান্নাত ও তাঁর স্বামী। গতকাল সন্ধ্যায় ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনতে একটু দেরি হওয়ায় ব্যালন দিয়ে ব্যাপক মারধর করেন। এতে তার চোখে রক্ত জমে যায়। সেলাই রেঞ্জ দিয়ে পায়ের নখ থেঁতলে দেন। চিৎকার করলে মেরে ফেলার ভয় দেখান। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না। রাতে দরজা খোলার সময় পাশের বাসার একজন তাকে দেখে ঘটনা জানতে চান। তখন সে তাঁকে ঘটনা খুলে বলে। পরে রাতে পুলিশ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে।

প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগে ওই কিশোরীর বাবা মারা গেলে তার মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। তখন থেকে ওই কিশোরী তার নানির বাড়িতে থাকত। পরে তার মায়ের পরিচিত শামীমের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতে তাকে যশোরে পাঠানো হয়। ৯ মাস আগে ওই কিশোরীকে যশোরে ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসেন শামীম।

ভুক্তভোগী কিশোরী জানায়, এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত সে। লেখাপড়া করানোর কথা বলে যশোরে আনলেও তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি। তিন বেলা ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হতো না। মাঝেমধ্যে তার মাকে কিছু টাকা পাঠাতেন গৃহকর্তা। ওই দম্পতির যমজ সন্তানের দেখাশোনাও করতে হতো তাকে।