জেলার রাজনীতি—১৭: ঝালকাঠিতে নতুন-পুরোনো দ্বন্দ্বে বিএনপি, আওয়ামী লীগে আমুই শেষ কথা

জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আমির হোসেন আমুই শেষ কথা। বিএনপির বিবদমান দুটি পক্ষ পাল্টাপাল্টি দলীয় কর্মসূচি পালন করছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর নির্দেশনাতেই চলে সব। জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আমির হোসেন আমুই শেষ কথা।

অন্যদিকে জেলা বিএনপিতে নতুন-পুরোনো নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকট। জেলা বিএনপির রাজনীতিতে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শাহজাহান ওমরের একসময় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বর্তমানে তাঁর অনুসারীরা অনেকটা কোণঠাসা। বিবদমান দুটি পক্ষ পাল্টাপাল্টি দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। গত তিন মাসে রাজপথে কোণঠাসা বিএনপির নেতা-কর্মীরা কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও দলের মধ্যে কোন্দল স্পষ্ট।

ঝালকাঠি-২ (সদর-নলছিটি) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমুকে জেলা আওয়ামী লীগের অভিভাবক হিসেবে মানেন দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা। ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের রাজনীতিতেও তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আছে। জেলার প্রতিটি সাংগঠনিক কমিটিতে সভাপতি-সম্পাদকসহ তাঁর মনোনীত ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছেন।

আগামী নির্বাচনে ঝালকাঠি-২ আসনে দলের একক প্রার্থী হিসেবে আমুর নাম শোনা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমু ছাড়া অন্য কারও ব্যানার-ফেস্টুনও নির্বাচনী এলাকায় দেখা যায়নি। জেলা আওয়ামী লীগের একসময়ের দাপুটে দুই নেতা—সাবেক পৌর মেয়র আফজাল হোসেন ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুলতান হোসেন খান আমুর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে দল থেকে ছিটকে পড়েছেন।

ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের নিজ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ কম। করোনার পরে তিনি এলাকায় তেমন একটা আসেননি। নির্বাচন সামনে রেখে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তৎপরতা বাড়ছে। এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুন টানানোর পাশাপাশি অনেকে গণসংযোগ করছেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে ছুটছেন। এ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য বজলুল হকের পাশাপাশি মনোনয়ন–দৌড়ে আছেন আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মনিরুজ্জামান, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ, কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল ও আওয়ামী লীগের ত্রাণ উপকমিটির সদস্য আবুল কাশেম।

দেশের বাইরে অবস্থান করা সংসদ সদস্য বজলুল হকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ জনসাধারণ তাঁর পাশে আছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলনে দ্বিতীয়বারের মতো সরদার মো. শাহ আলম সভাপতি ও খান সাইফুল্লাহ সাধারণ সম্পাদক হন। সম্মেলনের পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া চারটি উপজেলা, দুটি পৌরসভাসহ ৩২টি ইউনিয়নের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আমুর মনোনীত নেতারা স্থান পেয়েছেন। এ নিয়ে তৃণমূলে কিছুটা ক্ষোভ থাকলেও কেউ প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন না। অন্যদিকে আটটি সহযোগী সংগঠনের মধ্যে কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ ও মৎস্যজীবী লীগের কমিটি হালনাগাদ রয়েছে। আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম চলছে। এ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।

দলে তেমন কোনো প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ নেই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার মো. শাহ আলমের। অসুস্থতার কারণে দলীয় কর্মসূচিতেও তিনি নিষ্ক্রিয়। আমির হোসেন আমুর পরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ বেশ তৎপর। নেতা-কর্মীরা তাঁকে ‘ভাইজান’ সম্বোধন করেন। সর্বশেষ তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

খান সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দলীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত আমির হোসেন আমুর নির্দেশে বাস্তবায়ন করি। তিনি আমাদের অভিভাবক। তাঁর বিচক্ষণ রাজনীতির কারণে আমাদের দলে কোনো কোন্দল নেই। ঝালকাঠি-২ আসনে আমু ভাইয়ের বিকল্প নেই।’ তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচনে নৌকার পক্ষে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রতিটি সভা–সমিতিতেই উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

কোন্দলে বিভক্ত জেলা বিএনপি

জেলা বিএনপির রাজনীতিতে একসময় দলের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর তাঁর অনুসারীরা দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ২০২১ সালে ওমরপন্থী একাধিক নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। গত ২৩ আগস্ট সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যৌথভাবে কর্মসূচি পালন করা শুরু করে দুই পক্ষ। কিন্তু সম্প্রতি পদযাত্রা কর্মসূচির সময় শহরের আমতলা সড়কে দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করা নিয়ে দুই পক্ষের পুরোনো বিরোধ আবার সামনে আসে। কয়েক দিন ধরে তাঁরা আবার দলীয় কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন করছে।

জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ হোসেনকে আহ্বায়ক ও মো. শাহাদাৎ হোসেনকে সদস্যসচিব করে ২০২০ সালের নভেম্বরে দুই সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। পরে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তিন মাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করার কথা থাকলেও তিন বছরেও তা হয়নি। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় জেলা বিএনপি। এক পক্ষের নেতৃত্ব দেন শাহজাহান ওমরপন্থী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। অন্য পক্ষে আছেন বর্তমান কমিটির সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেন।

দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি চারটি উপজেলা ও দুটি পৌর কমিটিসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের সব সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেছে। এসব কমিটিতে নেতৃত্বে আছেন শাহাদাৎপন্থীরা। অন্যদিকে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ওমরপন্থী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোস্তফা কামাল, সদর উপজেলার সভাপতি সরদার এনামুল হক ও সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য শাহ আলম মোল্লার প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়। সম্প্রতি তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলেও সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বেড়েছে।

সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেন বলেন, আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর ইতিমধ্যে উপজেলা ও সমপর্যায়ের ইউনিটগুলোর নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি–সংক্রান্ত জটিলতায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। শিগগিরই কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে।

মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখানে পদ–পদবি নিয়ে সামান্য মতবিরোধ থাকতে পারে। তবে সরকার পতনের আন্দোলনে দলের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই।