আওয়ামী লীগ নেতাদের হারিয়ে ব্যবসায়ীর জয়ী হওয়ার নেপথ্যে কী

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বিল্লাল মিয়া
ছবি: সংগৃহীত

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতাকে হারিয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন ব্যবসায়ী বিল্লাল মিয়া। জেলা পরিষদের সদস্যপদ থেকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চেয়ারম্যান পদে উঠে আসায় জেলাজুড়ে নানা আলোচনা চলছে।

আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীর ভাষ্য, ব্যবসায়ী বিল্লাল মিয়ার টাকার কাছে হেরেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতারা। এই হারকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা।

কিন্তু অন্য একটি পক্ষ দাবি করছে, আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালীসহ অনেকের নীরব ভূমিকা, মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সক্রিয়ভাবে কাজ না করা, ভোটারদের চাপ প্রয়োগ করা, ভোট শুরুর আগে চেয়ারম্যান প্রার্থী বিল্লালের ওপর হামলা, আওয়ামী লীগ নেতাদের সামনে কথা বলতে না পারার ভয়, জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়াসহ বেশ কিছু কারণে জেলা পরিষদের নির্বাচনে প্রভাবশালী প্রার্থীরা হেরেছেন।

গতকাল শনিবার সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচন হয়। এতে ১ হাজার ৩৮৪ ভোটের মধ্যে পড়েছে ১ হাজার ৩৬৬ ভোট। অর্থাৎ ভোট পড়ার হার ৯৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। নির্বাচনে জেলা পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করা ব্যবসায়ী বিল্লাল মিয়া ৭৪৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও দুইবারের সাবেক পৌর মেয়র হেলাল উদ্দিন পেয়েছেন ৪৯০ ভোট। এ ছাড়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি শফিকুল আলম পেয়েছেন ১৩৩ ভোট। বিজয়ী প্রার্থী বিল্লালের তুলনায় হেলাল উদ্দিন এবং শফিকুল আলম অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত।

বিল্লাল মিয়া আশুগঞ্জ উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ তরুয়ার খলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তবে পরিবার নিয়ে তিনি জেলা শহরের শিমরাইলকান্দি এলাকায় বসবাস করেন। বিল্লাল একসময় কুয়েতপ্রবাসী ছিলেন। প্রায় ১০ বছর আগে দেশে এসে তিনি ডিম উৎপাদনের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি ঢাকায় পোশাকশিল্পের ব্যবসাও শুরু করেন। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে ৩ নম্বর ওয়ার্ড আশুগঞ্জ থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

জেলা পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে শুধু সদর উপজেলায় জয়ী হয়েছেন হেলাল উদ্দিন। বাকি আটটি উপজেলায় বিল্লাল মিয়া জিতেছেন।

আরও পড়ুন

জেলা পরিষদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল মামুন সরকারের মৃত্যুর পর বিল্লাল মিয়া চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বর্তমান পরিষদের সাত-আটজন মিলে আমরা তাঁর পক্ষে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি নিজেও ভোটারদের সঙ্গে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ও বিনয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁর আচরণে ভোটাররা মুগ্ধ।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ভোটারদের মন জয় করতে পারেননি।

আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল উদ্দিনকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনের সংসদ সদস্য ফয়জুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনের সংসদ সদস্য এ বি তাজুল ইসলাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ মনে করেন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা সমর্থন দিলেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই হেলালকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চাননি। তা ছাড়া ভোটারদের কাছে হেলাল উদ্দিন ও শফিকুল আলম নেতার ভঙ্গিমায় ভোট চেয়েছেন। তাঁদের কাছে ইউপি সদস্যরা তেমন মূল্যায়ন পাবেন না—ভোটারদের মনে এমন শঙ্কাও ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন ভোটার প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা সবাই হেলাল উদ্দিনকে ভোট দিতে ভোটারদের চাপ দিয়েছিলেন। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি সাধারণ ভোটাররা। অপর প্রার্থী শফিকুল তেমন কিছু করতেও পারছিলেন না। তাই ভোটাররা বিল্লালের দিকে ঝুঁকেছেন।

নির্বাচনের পরাজিত প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেম্বারদের (ইউপি সদস্য) টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে। ৫০ হাজার, ৭০ হাজার ও ১ লাখ টাকা করে মেম্বারদের দিয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ আমার পক্ষে ছিল।’

আরেক প্রার্থী শফিকুল আলম বলেন, ‘নেত্রী কাউকে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু এলাকার মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল উদ্দিনকে সমর্থন দিয়ে ভোট চেয়েছেন। কিন্তু কোথাও মুখ রক্ষা হলো না। দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। যেভাবে সবাই নেমেছিল, ভেবেছিলাম হেলাল উদ্দিন জয়ী হবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত নির্বাচনে ৫৫৩ ভোট পেয়েছিলাম। কিন্তু এবার কেন এমন হলো এবং বিজয়ী প্রার্থী কীভাবে এত ভোট পেলেন, বুঝতে পারছি না।’

ভোটারের কাছে ছুটে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিল্লাল মিয়া। ভোটাররাও তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন বলে মনে করেন তিনি। বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘কোনো ভোটারকে টাকা দিয়েছি, এমন একটি প্রমাণও কেউ দিতে পারবে না। পরাজিত হয়ে তাঁরা এমন বলছেন। তাঁরা শুরু থেকেই পেছনে লেগেছেন। আমার ভাইকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। ভোট শুরুর আগে আমার ওপর হামলা করিয়ে এক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। সবাই আস্থা রেখেছেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব।’