ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে বাড়িতে ফেরার দুই দিন পর নির্যাতনের শিকার কিশোরী গৃহকর্মীর মৃত্যু

মৃত্যুর খবর পেয়ে নীপা আক্তারের বাড়িতে গ্রামবাসীর ভিড়। গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাছুয়াডাঙ্গা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাছুয়াডাঙ্গা গ্রামের ১৩ বছরের কিশোরী নীপা আক্তার গৃহপরিচারিকা হিসেবে রাজধানীর মিরপুরের একটি বাসায় কাজ করত। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে পাঠানো হয়। গতকাল শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নীপার মৃত্যু হয়েছে।

গ্রামবাসীর অভিযোগ, ঢাকা থেকে ফেরার পর অসুস্থ নীপার দেহের বিভিন্ন অংশে ব্যান্ডেজ করা ছিল। ব্যান্ডেজের নিচে ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে। নীপার পরিবারের লোকজনের দাবি, গৃহপরিচারিকার কাজে যোগদানের আগে নীপা পুরাপুরি সুস্থ ছিল। তার দেহে এসব ক্ষতের দাগ কীসের, সেটা কেউ বলতে পারছেন না।

আজ শনিবার সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নীপার ময়নাতদন্ত হয়েছে। এর আগে নীপার সুরতহাল সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ কামাল। তিনি বলেন, নীপার দেহের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। এর আগে গতকাল রাতে পুলিশ বাদী হয়ে এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে।

নীপা আক্তার উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের মাছুয়াডাঙ্গা গ্রামের মো. মুর্শেদ আলীর ছোট মেয়ে। নীপার মা মারা গেছেন। বাবা মুর্শেদ দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। মুর্শেদের দ্বিতীয় স্ত্রী নাসিমা কয়েকবার ঢাকায় গিয়ে নীপার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। তবে নীপা যে বাড়িতে কাজ করত, সেই বাড়ির ঠিকানা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাসিমা বলেন, মিরপুর–১০ এলাকায় নীপা কাজ করত, এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।

নীপার বাবা মুর্শেদের ভাষ্য, হেদায়েত নামের মিরপুর এলাকার এক আবাসন ব্যবসায়ীর বাড়িতে নীপা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। তবে ওই বাড়ির মালিকের ব্যাপারে মুর্শেদও বিস্তারিত বলতে পারেননি। আড়াই বছর আগে ওই বাড়িতে কাজে যোগ দেয় নীপা। এরপর নীপা একবারও বড়িতে আসেনি। মাস শেষে মুর্শেদের কাছে বিকাশের মাধ্যমে আড়াই হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতেন হেদায়েত।

মুর্শেদ বলেন, গত রোববার নীপার অসুস্থতার খবর জানিয়ে ওই বাড়ির মালিক তাঁকে ঢাকায় যেতে বলেন। তাঁর কাছে টাকা নেই জানালে পরদিন ওই বাড়ির মালিক বিকাশের মাধ্যমে তিন হাজার টাকা পাঠান। ওই দিনই স্ত্রী নাসিমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঢাকায় যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর মেয়ে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে হাসপাতালের নাম তিনি জানেন না। বাড়ির মালিক তাঁকে জানিয়েছেন, নীপা কিছু একটা খেয়ে নিজেকে আঘাত করে অসুস্থ হয়েছে। এ কারণে চিকিৎসার জন্য তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল।

মুর্শেদের দাবি, ওই বাড়ির মালিক তাঁকে হাসপাতাল থেকে বাইরে বের হতে বাধা দেন। একপর্যায়ে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী নাসিমাকে ভয় দেখিয়ে একাধিক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেন ওই বাড়ির মালিক। পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে নীপাসহ তাঁদেরকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে ঈশ্বরগঞ্জের মাছুয়াডাঙ্গা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয়।

গতকাল বিকেলে মাছুয়াডাঙ্গা গ্রামের অন্তত ১৫ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গভীর রাতে অ্যাম্বেলেন্সটি গ্রামে ঢুকে নীপা ও তার মা–বাবাকে বাড়িতে নামিয়ে চলে যায়। গিয়াস উদ্দিন (৭০) নামের গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি ওই অ্যাম্বুলেন্সের চালককে নিঃশব্দে গ্রামে প্রবেশের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। চালক তখন তাঁদের বলেছেন, নীপার বাবার নির্দেশে তিনি সাইরেন বাজাননি।

গতকাল নীপার বাড়িতে গিয়ে প্রচুর লোকজনের ভিড় দেখা যায়। জানতে চাইলে উপস্থিত লোকজন বলেন, নীপাকে তাঁরা শেষবারের মতো দেখতে এসেছেন। নীপার বড় বোন কল্পনা আক্তার (২৪) বলেন, অসুস্থ অবস্থায় মঙ্গলবার গভীর রাতে তাঁর বোন বাড়িতে ফিরেছে। পরদিন সকালে তাঁর বাবা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একা যান। তবে চিকিৎসকেরা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দেন। পরে গ্রামের লোকজনের সহায়তায় বৃহস্পতিবার সকালে নীপাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সার্জারি–৩ ইউনিটের চিকিৎসক খালিদ হোসেন বলেন, ওই কিশোরীকে প্রথমে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল বলে তার স্বজনেরা জানিয়েছেন। কিন্তু পূর্বের কোনো ব্যবস্থাপত্র কিংবা চিকিৎসাসংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তাঁরা। ওই কিশোরীর চিকিৎসা করার সময় তার শরীরে বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। কিন্তু অভ্যন্তরে কী হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে তা জানা যায়নি। তবে কিশোরী উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। ময়নাতদন্ত প্রতিবদেন পেলে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

নীপার ভাবি মোছা. শাহনাজ বেগম বলেন, নীপার বুক থেকে তলপেট পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করা ছিল। তিনি ব্যান্ডেজ খুলে নীপার তলপেটের দুই পাশে ও বুকে কাটা দাগ দেখতে পেয়েছেন। কাটা দাগ দেখে মনে হয়েছে, সদ্যই নীপার অস্ত্রোপচার হয়েছে। শাহনাজের ধারণা, নীপার দেহ থেকে কোনো অঙ্গ খুলে নেওয়া হয়েছে।

রাজীবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আবদুল আলী ফকির বলেন, ওই কিশোরীর বাবা মুর্শেদ তাঁকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওই কিশোরী কীভাবে এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল, সেটা মুর্শেদ তাঁকে বিস্তারিত কিছু জানাননি।

মুর্শেদের দাবি, মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নিতে গতকাল দুপুরের দিকে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় গিয়েছিলেন। তবে পুলিশ তাঁর কথা শোনেনি।

এ বিষয়ে গতকাল রাতে ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি পীরজাদা শেখ মোস্তাছিনুর রহমান বলেন, ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে, সেই এলাকার থানায় গিয়ে আইনগত ব্যবস্থার আবেদন জানাতে হবে। তবে প্রতিকার বা পরামর্শ পাওয়ার জন্য ওই কিশোরীর পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ থানায় আসেননি বলে তিনি দাবি করেন।