নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তঘেঁষা পাড়াটিতে এখনো আতঙ্ক কাটেনি

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া। এখনো আতঙ্কে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হন না পাড়ার বাসিন্দারা। বুধবার সকালেছবি: এস এম হানিফ

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজারসংলগ্ন হিন্দুপাড়া। মাত্র ১৭টি পরিবারের বসবাস। পাড়ার দক্ষিণ প্রান্তে সুভাষ ধরের বাড়ি। সেখান থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে কাঁটাতার ঘেঁষে ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকি। বিজিপিকে হটিয়ে এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি সেখানে অবস্থান নিয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে গোলাগুলি নেই। এরপরও আতঙ্ক কাটছে না সীমান্তঘেঁষা পাড়ার বাসিন্দাদের।

তুমব্রু বাজারসংলগ্ন হিন্দুপাড়ায় সব মিলিয়ে ১০৪ জন মানুষের বাস। পাড়ার বেশির ভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। কেউ ইজিবাইক চালান, কেউবা সেলুন ও দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ ছাড়া সরকারি চাকরি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকও আছেন। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে সংঘাত শুরুর পর আতঙ্কে অনেকে পাড়া ছেড়ে আত্মীয়স্বজনসহ অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। গোলাগুলি কমলে আবার ফিরে আসেন। এক সপ্তাহ ধরে গোলাগুলি নেই। এর মধ্যে আতঙ্ক নিয়ে ছোট পরিসরে সরস্বতীপূজা উদ্‌যাপন করা হচ্ছে।

পাড়ার মধ্যেই একমাত্র প্রার্থনার ঘর শ্রীশ্রী দুর্গামন্দির। বুধবার সকালে মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, পূজা-অর্চনা চলছে। ব্রাহ্মণের কাছ থেকে দীক্ষা নিচ্ছেন কয়েকজন যুবক ও নারী। প্রতিবছর ধুমধাম করে সরস্বতীপূজার আয়োজন করা হলেও এবার তেমন আয়োজন নেই।

ব্রাহ্মণের কাছ থেকে দীক্ষা নিচ্ছিলেন তরুণ অজয় ধর (২৬)। তিনি বলেন, প্রতিবার অনেক আয়োজন করে সরস্বতীপূজা উদ্‌যাপন করা হয়। এবার সব আয়োজন চূড়ান্ত করা হলেও পরে ছোট করা হয়েছে। অজয় বলেন, এক সপ্তাহ ধরে গোলাগুলি নেই। তবু প্রতিটি পরিবারে আতঙ্ক। এ জন্য আয়োজন ছোট করা হয়েছে। পুণ্যার্থী রুবি বালা ধর (২৩) বলেন, ‘৩ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রাম ছেড়ে উখিয়ায় অবস্থান করছিলাম। আজ সকালে পূজার জন্য বাড়িতে এসেছি। বাচ্চাদের নিয়ে এখানে থাকতে খুব ভয় হয়।’

মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি স্কুলশিক্ষক রুপলা ধর প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো ইউনিয়নে একটিমাত্র হিন্দুপাড়া। এলাকার মুসলিমরা আমাদের বিভিন্ন উৎসবে সহযোগিতা করেন। তাঁদের দ্বারা আমরা কখনো ক্ষতির মুখোমুখি হইনি।’

আতঙ্কের মধ্যে সরস্বতীপূজা উদ্‌যাপন করছেন নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা। বুধবার সকালে পাড়ার একমাত্র মন্দিরে
ছবি: প্রথম আলো

পাড়ার বাসিন্দারা জানান, ওপারে সীমান্তচৌকি দখলে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। এখন সেখানে সংঘর্ষ না হলেও তারা অহেতুক নিজেরা নিজেরা গুলি ছোড়ে। রাতে নাচগান করে। আতঙ্কে তাঁদের নির্ঘুম থাকতে হয়। বড় কোনো আওয়াজ শুনলে শিশুরা এখনো ভয়ে জড়সড় হয়ে যায়। স্থানীয় কয়েকজন সীমান্তঘেঁষা এলাকা থেকে তাঁদের বসতি সরিয়ে অন্যত্র পুনর্বাসনের দাবিও তোলেন। তবে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চাননি।

সেই দিনের স্মৃতি মনে করে এখনো আঁতকে ওঠেন ওই পাড়ার বাসিন্দা শুভ দাশ (৩০)। তিনি বলেন, ভোররাতে প্রচণ্ড গোলাগুলি ও মর্টার শেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কেঁপে ওঠে পাড়ার প্রতিটি ঘর। মনে হচ্ছিল, তাঁদের ঘরবাড়িতে আক্রমণ হচ্ছে। এত গোলাগুলি জীবনেও দেখেননি। ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে গ্রামের মুরব্বি প্রবীন্দ্র ধর গুলিবিদ্ধ হন। এতে আতঙ্কিত হয়ে সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যান। শুভ বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি ভোরে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে হামলা করে আরকান আর্মি। তুমুল লড়াইয়ে বিজিপি সদস্যদের হটিয়ে ক্যাম্প দখল করে নেয়। পরে ক্যাম্পের ৬৮ জন বাংলাদেশে ঢুকে বিজিবির কাছে আশ্রয় নেয়।

ওপার থেকে আসা গুলিতে আহত প্রবীন্দ্র ধর (৫৫) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা স্বাধীন দেশে বাস করি। কিন্তু তাঁদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের খেসারত আমাদেরও দিতে হচ্ছে। ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে বাড়ির উঠানে দাঁড়াতেই একটি গুলি বাহুতে এসে পড়ে। এতে আতঙ্কে সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যায়।’

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই পাড়ায় কিছুটা ভয় আছে। তাঁদের পাড়াটি সীমান্তের কাঁটাতারঘেঁষা হওয়ায় ভয়টা তাঁদের বেশি। দিনে অন্তত দুবার ওই পাড়ায় খোঁজখবর নেন বলে তিনি জানান।

অঞ্জলি ধর, রুপনা ঘোষ ও বিনা ধর নামের তিন নারী বলেন, তাঁরা এখনো আতঙ্কে আছেন। ওপারের সংঘর্ষ অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও থামানো উচিত। এই সংঘর্ষের কারণে তাঁরা কষ্টে আছেন।