ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া সংগ্রহশালা, আছে ৪০০ বছর আগের ইটসহ নানা দুর্লভ জিনিস

আলী মাহমেদের বাড়ির প্রতিটি কক্ষ, সিঁড়ির পাশের প্রতিটি দেয়াল পুরোনো নানা জিনিস দিয়ে সাজানোছবি: প্রথম আলো

পুরোনো ক্যালকুলেটর, শত বছরের পুরোনো টাইপ রাইটার, ১৩০ বছর আগের ঘড়ি, দেড় শ বছরের পুরোনো লাঠি, ৪০০ বছর আগের ইট, গ্রামোফোনসহ নানা দুর্লভ জিনিসে ভরা এক সংগ্রহশালা। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বাসিন্দা আলী মাহমেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে।

আখাউড়ার বড় বাজার মসজিদের পেছনে আলী মাহমেদের বাড়ি। সম্প্রতি সেই বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে চারপাশজুড়ে থাকা গাছপালা। বাড়িটির উত্তর দিকে আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশন। দক্ষিণ দিকে গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো চেয়ার। আছে ফায়ারপ্লেস। ঘরে ঢুকতেই পুরোনো সব জিনিস স্বাগত জানায়, নিয়ে যায় সুদূর অতীতে। বাড়ির প্রতিটি কক্ষ, সিঁড়ির পাশের প্রতিটি দেয়াল পুরোনো নানা জিনিস দিয়ে সাজানো।

ফায়ারপ্লেসের স্থানে ৪০০ বছর পুরোনো ইট। তির, ধুনক, টাইপরাইটার, গ্রামোফোন, ভিনাইল রেকর্ড, বুকশেলফে সাজানো সারি সারি বই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই হাতের বাম পাশের দেয়ালে শেলফে পুরোনো টেপ রেকর্ডার, কম্পিউটার, বাদ্যযন্ত্র, ক্যাসেট প্লেয়ার, ১৯৫৭ সালের টেলিফোন সেট, পুরোনো ছোট টেলিভিশন। আরেকটি শেলফে সাজানো বিভিন্ন ধরনের পুরোনো জিনিসের সংগ্রহ।

আলী মাহমেদ একজন লেখক। তিনি এলাকায় সবার কাছে মোহাম্মদ আলী নামে পরিচিত। তাঁর বাবা প্রয়াত নিজাম উদ্দিন আহমেদ আখাউড়ার দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। দেশি-বিদেশি লেখকের বই, নিজের লেখা সব বই এবং নব্বইয়ের দশকে পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রতিটি লেখা যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন আলী মাহমেদ।

পুরোনো জিনিস সংগ্রহে নিজের আগ্রহের প্রসঙ্গে আলী মাহমেদ বলেন, ‘১৯৮৩ সালে বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর বাবার সবকিছু জুতা, মোজা, চশমা ইত্যাদি সংগ্রহ করা শুরু করি। সম্ভবত এখান থেকেই দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র সংগ্রহের আগ্রহ তৈরি হয়। প্রাচীন, দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহ করার শখ হয়। যখন যেখানে যা পেয়েছি সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা করেছি। যাঁরা আমাকে চেনেন, তাঁরা জানেন আমি দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পছন্দ করি। বিভিন্ন এলাকার অনেক লোক নিজ উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবান জিনিসপত্র এনে আমার কাছে দিয়ে গেছেন।’

আখাউড়ায় আলী মাহমেদের সংগ্রহে হুঁক্কা, বল্লম, বদনা, পাদুকা, থালাবাটি, কোরবানির ছুরি, যুদ্ধের অস্ত্র, কলের গান, ঢাকঢোল, মঙ্গলসূত্র, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশের খড়ের পণ্য, ঘোড়ার চাবুক, খুন্তি, লাঙল, দা, মই, হাতুড়ি, ফলা, কাস্তে, পুঁথি, বাঁশি, সানাই, টোপর, তযবিহ, জায়নামাজসহ হাজারখানেক জিনিসপত্র আছে। তবে সন্তানদের পড়াশোনার জন্য তাঁকে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। অনেক জিনিস তিনি ঢাকার বাসায় নিয়ে গেছেন। 

ঢাকার বাসায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরনের কাপড়, গুলির বাক্স, তামার বুলেট ও খোসা, ১৯৬০ সালের ক্যামেরা, পুরোনো ইয়াসিকা ক্যামেরা, টিঅ্যান্ডটির সঙ্গে ব্যবহৃত প্রাচীন মডেম, ১৯৯৬ সালে কেনা বাংলা সফটওয়্যার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেডেল, চোখ পরীক্ষা করার যন্ত্র, তাঁর নানির ১৯৪২ সালের শাড়ি, ১৯৫৫ সালের পত্রিকা তওহীদ–এর একটি কপি, টেলিস্কোপ, জাহাজের বাতি ও কম্পাস, রেলের বাতি (লাল, সবুজ ও হলুদ), কলমের কালি রাখার পাত্র, সিলভারের পানদানি, তাঁর নানার ১৯৪২ সালের চশমা, বাবার হাতের ঘড়িসহ অনেক কিছু রেখেছেন।

আলাপে আলী মাহমেদ জানালেন, আবদুল জব্বার বীর প্রতীক তাঁকে ১৯৭১ সালের গুলির বাক্স দিয়েছেন। একজন পবিত্র হজ পালনে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় তাঁর জন্য মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর রওজা শরিফের একটি পাথর এনেছিলেন। সেটি তিনি নিজের সংগ্রহশালায় রেখে দিয়েছেন। 

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আলী মাহমেদের সংসার। স্ত্রী ফারজানা আফরোজ গৃহিণী। ছেলে আহমেদ ইফতেখার অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন এবং মেয়ে নাহিয়ান আঞ্জুম মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি জানালেন, সংগ্রহশালার জিনিসপত্র নিয়ে ছেলের বেশ আগ্রহ আছে। তাঁর স্ত্রী নিয়মিত এসব পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে তাঁকে সহায়তা করেন।

আলী মাহমেদের সংগ্রহের বেশির ভাগই আখাউড়ার বাড়িতে। তাঁর কাছে এমন অনেক জিনিস আছে, যেগুলো তরুণ প্রজন্ম নিজের চোখে দেখেনি। তাদের জন্য তিনি এসব রেখে যাচ্ছেন। তাঁর আশা, এগুলো একদিন সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবে সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা।