একটি গুলি সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে
মাধ্যমিক পাস করে দারিদ্র্যের জন্য আর লেখাপড়া করতে পারেননি রমজান মিয়া (২৩)। সংসারের অভাব দূর করতে রাজধানীর রামপুরায় একটি কেক-বিস্কুটের প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মীর কাজ নেন। বছর চারেক ধরে সেখানে থেকেই কাজ করতেন তিনি। নিজে লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে না পারলেও রমজানে ইচ্ছে ছিল তাঁর ছোট দুই ভাইবোনকে উচ্চশিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তাঁর মায়েরও ইচ্ছা ছিল ছেলের বাড়তি উপার্জনে বাড়িতে একটি টিনের ঘর তোলার। কিন্তু একটা গুলিতে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে গত ১৯ জুলাই সকালে ঢাকার রামপুরা এলাকার ওমর আলী গলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রমজান। পরদিন গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে দাফন করা হয় তাঁকে।
রমজান মিয়া নেত্রকোনা সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের নন্দীপুর গ্রামের দিনমজুর লিটন মিয়া ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির ছেলে। তিন সন্তানের মধ্যে রমজান বড়।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রমজানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ ছোট্ট ঘরে তাঁদের বসবাস। বাড়ির সামনে থাকা ছোট জায়গায় রমজানকে কবর দেওয়া হয়েছে। কবরের পাশে তাঁর মা মনোয়ারা বেগম ছেলের শোকে কাতর হয়ে বসেছিলেন। মনোয়ারা বলেন, ‘অভাবের সংসার আমার। অনেক কষ্ট কইরা ছেলেডা মেট্রিক পাস করছিল। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম তারে লইয়া। ঢাকায় বিস্কুট কোম্পানিতে চাকরি কইরা তার ভাইবোনদের পড়াত। তার স্বপ্ন আছিল ভাই বোনদের বড় লেহাপড়া শিখাইব। বাড়িত ঘর তোলব। কিন্তু একটা গুলিতে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আমার আর কোনো আশা নাই। আমার পৃথিবী শেষ, আল্লাহ আমারে যেন ছেলের কাছে লইয়া যায়। আমি কারও কোনো বিচার চাই না। শুধু আল্লার কাছে ছেলে হত্যার বিচারের ভার দিলাম।’ এসব কথা বলে বিলাপ করছিলেন মনোয়ারা।
মনোয়ারা বেগম বলেন, ১৯ জুলাই সকালে রমজান রামপুরা এলাকার ওমর আলী গলিতে একটি হোটেলে খেতে যান। সঙ্গে থাকা তাঁর খালু গোলাম মোস্তফা আগে খাবারের দোকানটিতে ঢুকে পড়েন। পেছনে থাকা রমজান দরজার কাছ পর্যন্ত যেতেই হঠাৎ একটা গুলি এসে তাঁর গলায় ঢুকে পড়ে। মুহূর্তেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত লোকজন তাঁকে রিকশায় করে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান।
পরিস্থিতি খারাপ দেখে চিকিৎসক দ্রুত রমজানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু পথেই তাঁর মৃত্যু হওয়ায় আর ওই হাসপাতালে না গিয়ে একটি পিকআপ ভ্যানে করে গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে আসা হয়। রাত ১১টায় লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে ওই দিন রাত ১২টায় জানাজা নামাজ শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।
রমজানের ছোট ভাই একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহীন মিয়া বলেন, ‘আব্বা এখন অসুস্থ। তিনি তেমন কাজকাম করতে পারেন না। আমরা দুই ভাইবোন লেখাপড়া করি। আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন রমজান ভাই। মরণের আগের দিন ভাই ফোন করে আমারে কইছিল, দেশের অবস্থা ভালা না, সাবধানে থাকতে। আমি যাতে ঘোরাফেরা না করে লেখাপড়া করি। আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, আমি তাদের শাস্তি চাই।’
রমজানের বাবা লিটন মিয়া খুবই দরিদ্র মানুষ বলে জানান প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, টিন–বাঁশের ছোট একটা ভাঙাচোরা ঘর আর বাড়ির জায়গা ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই তাঁর। আগে দিনমজুরি করে সংসার চালিয়েছেন। পাশাপাশি সন্তানদের বড় করেছেন। এখন আর কাজ করতে পারেন না।
বাবা লিটন মিয়া বলেন, ‘রমজানের আয় দিয়াই পরিবার চলত। ছেলেডার মরণে আমার সব শেষ হইয়া গেছে। এই মৃত্যুর বিচার চাওয়ারও জায়গা নাই। আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। বাবার ঘাড়ে সন্তানের লাশ নেওয়া যে কতটা ভারী, তা শুধু সন্তানহারা বাবাই জানে। আমার নিষ্পাপ ছেলেডার মরণ যে এমন কইরা হইব, তা কোনো দিনও ভাবছিলাম না।’