কী আছে কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনে

কক্সবাজার শহরতলির ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ার ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। উদ্বোধনের আগেই চারপাশের দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করেছেছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কাছে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় নির্মিত হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন ছয়তলাবিশিষ্ট আইকনিক রেলস্টেশন। ২৯ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের রেলস্টেশনটি উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামীকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে রেলস্টেশন এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নতুন এই রেলস্টেশনে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সুবিধা। দৈনিক ৪৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আইকনিক রেলস্টেশনে আরও আছে ডাকঘর, কনভেনশন সেন্টার, তথ্যকেন্দ্র, এটিএম বুথ ও প্রার্থনার স্থান।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রেলস্টেশনটি পরিদর্শন করেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রেল চলাচলের জন্য এ স্টেশন ও রেলপথ প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ ও রেলস্টেশন উদ্বোধনের পর অর্থনীতির নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। এ সময় তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. সবুক্তগীন।

রেলস্টেশন ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত উপভোগ করতে কক্সবাজারবাসী অধীর আগ্রহে আছেন। এই রেললাইন ও স্টেশন তাঁদের কাছে শত বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। স্থানীয় লোকজন মনে করেন, রেল যোগাযোগ স্থাপনের পর কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ পর্যটনের নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটবে।

কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কক্সবাজারে ট্রেন আসবে, এটা মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছায় সেই কল্পনা-স্বপ্ন দুটোই এখন বাস্তবতা। রেল চালুর পর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কপথে মানুষের চাপ, দুর্ভোগ ও দুর্ঘটনা কমে আসবে।’

কী আছে আইকনিক রেলস্টেশনে

২৯ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকায় বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রকল্পটি। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণে খরচ হচ্ছে ২১৫ কোটি টাকা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্মকর্তারা বলেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছয়তলা ভবনের রেলস্টেশনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে পদচারী–সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। আবার ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যাত্রীরা পা বাড়াবেন সমুদ্রসৈকতের দিকে। গমন ও বহির্গমনের জন্য তৈরি হয়েছে পৃথক দুটি সড়ক। আছে গাড়ি পার্কিংয়ের পৃথক তিনটি বড় জায়গা।

ভবনের পূর্ব পাশে নির্মিত হয়েছে ৮০ ফুট লম্বা পদচারী–সেতু। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় পৃথক তিনটি চলন্ত সিঁড়ি। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ভবনের উত্তরে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের ৩টি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে।
মূল ভবনের নিচতলার রাখা হয়েছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কক্ষ, লকার, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী–সেতুতে যাতায়াতের পথ। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল, শিশুযত্ন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল, চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়।

কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম
ছবি: প্রথম আলো

১০১ কিলোমিটারের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে আইকনিক এই রেলস্টেশন। ঢাকা থেকে রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজার নেমে পর্যটকেরা লাগেজ, মালামাল স্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে। স্টেশন ভবনের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচতলাবিশিষ্ট ২০টি ভবন।

ঘুরবে অর্থনীতির চাকা

আইকনিক রেলস্টেশন দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসছেন। কিন্তু উদ্বোধনের আগে নিরাপত্তার কারণে তিন দিন ধরে কেউ স্টেশনের কাছে যেতে পারছেন না। আগামীকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের পর সেখানে হাজারো মানুষের ঢল নামবে জানিয়ে কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন ছিল কক্সবাজারবাসীর শত বছরের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য শেখ হাসিনার প্রতি কক্সবাজারবাসীর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প
ছবি: প্রথম আলো

ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, চান্দেরপাড়ায় আইকনিক রেলস্টেশন নির্মিত হওয়ায় সেখানকার জায়গাজমির দাম বেড়েছে অনেক। পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। পরিবর্তন আসছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনেও।

পর্যটনের আমূল পরিবর্তন ঘটাবে জানিয়ে কক্সবাজারের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ, সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ, টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানির মালামাল পরিবহনে সুবিধা বাড়বে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের।