সেই ‘ভাতের হোটেলে’ এখন ভোটের উত্তাপ

চাকসু ভবন এত দিন ছিল মূলত ক্যানটিন আর কমিউনিটি সেন্টার। কর্মচারীদের সন্তানের বিয়ে থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে এখানে। এ কারণে গত ৩০ জুন শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে নামফলকের ওপর ব্যানার টাঙিয়েছিলেন—‘জোবরা ভাত ঘর ও কমিউনিটি সেন্টার’।

চাকসু ভবনের নামফলকের ওপর ‘জোবরা ভাত ঘর ও কমিউনিটি সেন্টার’ লিখে ব্যানার টাঙিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। গত ৩০ জুন তোলাফাইল ছবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু ভবন একসময় শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল কেবল ‘ভাতের হোটেল’। দুপুরে ৩০ টাকার মোরগ পোলাও, ৫ টাকার চা, ৫ টাকার শিঙারা খেতে শিক্ষার্থীদের ভিড় জমত প্রতিদিন। সেই ভবনেই এখন অন্য দৃশ্য—৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচনের হইচই।

ক্যাম্পাসের জারুলতলার পাশে তিনতলা চাকসু ভবন এখন ব্যস্ততম জায়গা। নিচতলায় ক্যানটিন, তার ওপরে নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী কার্যালয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কমিশনের সদস্যরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। মনোনয়নপত্র যাচাই, তালিকা প্রস্তুত, চূড়ান্ত ভোটার তালিকা তৈরি—সবই চলছে ‘মহাসমারোহে’। প্রার্থীদের আনাগোনায় ভবনের সিঁড়ি এখন যেন এক ছোট্ট রাজনৈতিক মঞ্চ।

গতকাল সোমবার গিয়ে দেখা গেল, নতুন করে সাজানো হচ্ছে চাকসু ভবন। দেয়ালে রঙের প্রলেপ, মেরামত করা হচ্ছে ভাঙা দরজা-জানালা। ক্যানটিনের টেবিলে বসে এবার শুধু খাবার নয়, চলছে প্রার্থী আর ভোটারদের টান টান আড্ডা।

গতকাল চাকসু ভবনেই পাওয়া গেল যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী দোস্ত মোহাম্মদকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকসু নির্বাচন হবে, এটা কখনো ভাবিনি। অবশেষে হচ্ছে। তবে প্রতিবছর নির্বাচন না হলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ বদলাবে না। এই এক নির্বাচনও কাজে আসবে না।’

ভোটের মঞ্চ

চাকসু ভবন এত দিন ছিল মূলত ক্যানটিন আর কমিউনিটি সেন্টার। কর্মচারীদের সন্তানের বিয়ে থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে এখানে। এ কারণে গত ৩০ জুন শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে নামফলকের ওপর ব্যানার টাঙিয়েছিলেন—‘জোবরা ভাত ঘর ও কমিউনিটি সেন্টার’। যদিও পরে প্রশাসন ব্যানার সরিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের কাছে তাই চাকসু ভবন মানেই ছিল সস্তায় ভাত খাওয়ার জায়গা। এবার সেই ভবন ভোটের মঞ্চে রূপান্তরিত হলো।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, ‘এবারের চাকসু নির্বাচন ভাতের হোটেলের দুর্নাম মুছে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বসিত। আমি চাইব, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে এ নির্বাচন স্থায়ীভাবে যুক্ত হোক।’

নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫৯ বছরে হয়েছে মাত্র ছয়বার। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সে নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য প্যানেল বিজয়ী হয়েছিল। এরপর ছাত্রসংগঠনগুলোর দ্বন্দ্ব, অস্থিরতা আর প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় দীর্ঘ বিরতি ছিল।

এবারের চাকসু নির্বাচন ভাতের হোটেলের দুর্নাম মুছে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বসিত। আমি চাইব, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে এ নির্বাচন স্থায়ীভাবে যুক্ত হোক।
অধ্যাপক মনির উদ্দিন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার

এ শূন্যতা ভরাটের দাবিতে আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর আন্দোলন জোরালো হলে প্রশাসন নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচন কমিশনও গঠন করা হয়। সংশোধন করা হয় চাকসুর গঠনতন্ত্র। একপর্যায়ে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তফসিল অনুযায়ী, প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হবে ২৫ সেপ্টেম্বর। আর ভোট হবে আগামী ১২ অক্টোবর।

নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আসফা তানিশা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই এত বড় ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হব, ভাবিনি। পরিচিত অনেকে প্রার্থী হয়েছেন। তবে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব, পড়াশোনা আর যোগাযোগ—সবই দেখব।’

নতুন করে সাজানো হচ্ছে চাকসু ভবন। দেয়ালে রঙের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা
ছবি: সৌরভ দাশ

প্যানেলে–প্যানেলে লড়াই

এবারের চাকসু নির্বাচনে লড়তে ইতিমধ্যে ১২টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রদল, বাম সংগঠন, ছাত্রশিবির, বিভিন্ন ক্লাব থেকে শুরু করে স্বতন্ত্রভাবেও শিক্ষার্থীরা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে ৯৩১টি। যদিও নির্বাচন কমিশন প্রাথমিক বাছাই শেষে ১৯ জনের মনোনয়নপত্র বাদ দিয়েছে।

এতসংখ্যক শিক্ষার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করার বিষয়টি ‘স্বাভাবিক’—এমনটাই বলছেন ভোটাররা। গত তিন দিনে বিভিন্ন বিভাগের ৫০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর নির্বাচন হওয়ায় সবাই আগ্রহী হয়েছেন।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোন কোন প্যানেলে হতে পারে—এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, আলোচনায় চারটি প্যানেল রয়েছে। তবে প্রার্থীদের সার্বিক কার্যক্রম দেখে তাঁরা শেষ মুহূর্তে ভোটের সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ানোর অতীত ইতিহাস, ব্যক্তিত্ব—সবকিছুই তাঁরা নজরে রাখবেন।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোন কোন প্যানেলে হতে পারে—এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, আলোচনায় চারটি প্যানেল রয়েছে। তবে প্রার্থীদের সার্বিক কার্যক্রম দেখে তাঁরা শেষ মুহূর্তে ভোটের সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ানোর অতীত ইতিহাস, ব্যক্তিত্ব—সবকিছুই তাঁরা নজরে রাখবেন।

এবারের চাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে কোনো নারী প্রার্থী নেই। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে কেবল একজন নারী অংশ নিচ্ছেন। যে প্যানেল থেকে একমাত্র নারী প্রার্থী হয়েছেন, তা হলো ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোট’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন একত্র হয়ে এ প্যানেল দিয়েছে। জিএস পদে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাসনীম জাহান শ্রাবণ। তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। তাসনীম জাহান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। এ পদে তিনি যোগ্য। নির্বাচিত হতে পারলে নানা সংকট নিয়ে কাজ করবেন।