রামুর ‘স্বর্গ জাহাজ’ ভাসানোর উৎসবে কী হয়, কত বছর ধরে হচ্ছে

কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীতে চলছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ‘স্বর্গের জাহাজ’ ভাসানো উৎসব। আজ বিকেলেছবি: প্রথম আলো

পঙ্খিরাজ, হাতি, ময়ূরপঙ্খি, কবুতর ও বুদ্ধজাদির আকৃতির সাতটি জাহাজ। সত্যিকারের জাহাজ নয়, ‘কল্প জাহাজ’। বাঁকখালী নদীর তীরে ভ্যানে করে দল বেঁধে জাহাজগুলো নিয়ে আসেন পুণ্যার্থীরা। এরপর নৌকায় ভাসিয়ে দেন এসব কল্প জাহাজ। পুণ্যার্থীরা একে স্বর্গের জাহাজও বলেন। নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে একসময় চোখের আড়াল হয়ে যায় জাহাজগুলো। বুঝি স্বর্গেই চলে যায়।

বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমার শেষ দিনে কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীর ফতেখাঁকুল, শ্রীকুল ও পূর্ব রাজারকুল অংশে ২০০ বছর ধরে এই জাহাজ ভাসানোর উৎসব হয়ে আসছে।

আজ মঙ্গলবার বিকেল চারটার দিকে রামুতে এই উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। জাহাজ ভাসানো উৎসবের উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান, পুলিশ সুপার মো. সাইফউদ্দিন শাহীন, কক্সবাজার-৩ (সদর, রামু ও ঈদগাঁও) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান কাজল, রামুর রাংকোট বৌদ্ধ বিহারের পরিচালক জ্যোতিসেন মহাথের ও একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া।

বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জানালেন, আড়াই হাজার বছর আগে বৈশালী রাজ্যে অনাবৃষ্টি, খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর প্রভাবে মানুষ ও জীবজন্তু মারা যাচ্ছিল। তখন গৌতম বুদ্ধ বৈশালী রাজার আমন্ত্রণে শিষ্যদের নিয়ে ওই রাজ্যে যান। তিনি ‘রত্ন সূত্র’ পাঠ করে খারাপ দেবতার প্রভাব থেকে বৈশালীকে রক্ষা করেন। ফিরতি পথে সর্প দেবতারা ৫০০টি নৌকায় শিষ্যসহ বুদ্ধকে নদী পার করে দেন। সেই দিনকে স্মরণ করতেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ জাহাজ ভাসানো উৎসব পালন করে আসছেন। প্রতিবছর তিন মাস ভিক্ষুদের বর্ষাব্রত পালন শেষে প্রবারণা পূর্ণিমার শেষ দিন জাহাজ ভাসানো উৎসব হয়।

বাঁকখালী নদীতে ভাসছে স্বর্গের জাহাজ। আজ বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

উৎসব সম্পর্কে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ও কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ মহাথের বলেন, ২০০ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহনঘা এলাকায় একটি নদীতে সংঘরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এই উৎসব প্রচলন হয়। রামু ছাড়া দেশের কোথাও স্বর্গ জাহাজ ভাসানো উৎসব হয় না। এই উৎসবের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা মহামতি বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

আজ বেলা দুইটার পর থেকে বাঁকখালী নদীর পূর্ব রাজারকুল ঘাটে জড়ো হতে থাকেন ভক্তরা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে সাতটি জাহাজ আনা হয় নদীতে ভাসানোর জন্য। প্রথমে নদীতে ভাসানো হয় পঙ্খিরাজ। তারপর ময়ূর, হাতি, বুদ্ধজাদি আকৃতির জাহাজ। ভাসতে ভাসতে জাহাজগুলো ছুটছিল নদীর এদিক-সেদিক। বাঁশ, বেত ও রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি ‘স্বর্গ জাহাজ’গুলো নৌকায় ওপর বেঁধে নদীতে ভাসানো হয়।

প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রামুসহ জেলার অন্তত ৩০টি বিহারে দুই শতাধিক ফানুস ওড়ানো হয়। দিনভর চলে বুদ্ধপূজা, অষ্টশীল গ্রহণ, মহা সংঘদান, ধর্মসভা ও সমবেত মঙ্গল প্রার্থনা।