যশোরে নদের জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্প

ঘর নির্মাণ না করতে জেলা প্রশাসককে পাউবোর চিঠি। তীরের জায়গা ভরাটে নদ থেকে বালু তোলায় ভাঙনের শঙ্কা স্থানীয় বাসিন্দাদের।

হরি নদের জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সম্প্রতি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

যশোরের মনিরামপুরে হরি নদের জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। এ জন্য নদের পাড়ের নিচু জায়গা ভরাট করতে অবৈধভাবে হরি নদ থেকে বালু তোলা হচ্ছে।

উপজেলার কপালিয়া গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে ১৪টি ঘর নির্মাণ করা হবে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। নদের জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ না করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ১২ নভেম্বর যশোরের জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠিও দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পাউবো যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম মমিনুল ইসলাম। উপজেলা প্রশাসনের দাবি, নদের সীমানা বাদ দিয়েই ঘর নির্মাণ করা হবে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবদহ অঞ্চলের মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ–নদীর পানি চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খননকাজ হয়েছে। খননের মাটি এসব নদ–নদীর তীরে ফেলা হয়। বেশির ভাগ জায়গা থেকে মাটি সরানো হয়নি। ওই মাটি নদ–নদীতে পড়ে এসব নদ–নদী আরও ভরাট হয়েছে। কপালিয়ায় ভরাট হয়ে যাওয়া নদের জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে।

১ ও ১০ নভেম্বর সরেজমিন দেখা যায়, কপালিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে কপালিয়া সেতু। সেখান থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে নদের বাঁকসংলগ্ন পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে অনেকটা জায়গাজুড়ে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কেটে উঁচু করে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদে ভাসছে একটি পাটাতন (বোর্ড)। সেখানে স্থাপিত দুটি শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে বালু তুলে ফেলা হচ্ছে বাঁধ দেওয়া স্থানে।

এলাকাবাসী জানান, কপালিয়া সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে পূর্ব ও পশ্চিম পাশে নদ–সংলগ্ন গুচ্ছগ্রামের শেষ অংশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে সেতুর পূর্ব পাশের ১৪ শতাংশ জমি হরি নদের তীরে এবং সেতুর পশ্চিম পাশের ১৪ শতাংশ জমি হরি নদের জায়গায়। হরি নদের পূর্ব দিকে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চেঁচুড়ি গ্রাম। পশ্চিম দিকে মান্দ্রা গ্রাম। ওই গ্রামের বাসিন্দা আবদুল গফফার সরদার বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও এই জায়গায় হরি নদ বেশ বড় ছিল। নদ বুজে এখন খালের মতো হয়ে গেছে। বুজে যাওয়া নদের জায়গায় ঘর বানানো হবে শুনেছি।’

নদের জায়গা ভরাটে বালু তোলা হচ্ছে আবদুস সামাদ নামের এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে। তিনি বলেন, ‘সরকারি ঘর হবে; কিন্তু জায়গা নিচু। এ জন্য পিআইও স্যারের কথামতো নদ থেকে বালু তুলে ওই নিচু জায়গা ভরাট করে দিচ্ছি।’ আবদুস সামাদ বলেন, প্রতি ঘনফুট আট টাকা দরে বালু তুলছেন। তিনজন শ্রমিক নিয়ে কাজ করছেন। বালু তুলতে ১৪ থেকে ১৫ দিন লাগবে।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এর ধারা ৪ অনুযায়ী, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা–বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। ধারা ৭ অনুযায়ী, অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কোনো সরকারি কার্যক্রম বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনে বালু বা মাটি উত্তোলনের ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে না। তবে এ জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন হবে। আর এই কর্তৃপক্ষ হবে ভূমি মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এস এম আবু আবদুল্লাহ বায়েজিদ বলেন, ‘যেখানে ঘর নির্মাণ করা হবে, সেটি নদের জায়গা কি না, বলতে পারব না। তবে নদের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প নেওয়া হয়নি।’ বালু তোলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সরকারি উন্নয়নকাজে নদ থেকে বালু তোলা যাবে। তবে আমি বালু তুলছি না। কারা বালু তুলছে আমি জানি না।’

নদের জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ না করতে জেলা প্রশাসকের কাছে পাউবোর দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হবে, ১৯২৬ সালের ভূমি জরিপ (সিএস) রেকর্ডে সেটি নদের জায়গা ছিল। কিন্তু সর্বশেষ ভূমি জরিপ (আরএস) রেকর্ডে ওই জমি প্লট আকারে খাস খতিয়ান এবং ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়েছে। পানি আইন অনুযায়ী ওই জায়গা নদের।

বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ অনুযায়ী, বছরের যেকোনো সময় ভরা কটালে নদীর সর্বনিম্ন পানির স্তর থেকে সর্বোচ্চ পানির স্তরের মধ্যবর্তী অংশকে নদীতট (ফোরশোর) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০ অনুযায়ী, নদীর দুই ধারের যে অংশ শুষ্ক মৌসুমে চর পড়ে এবং বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়, তা নদীতট নামে অভিহিত। এ এলাকায় কোনো ব্যক্তির অধিকার থাকে না। কেউ এ জমি দখল করলে তিনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

জানতে চাইলে মনিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, কপালিয়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নদের জায়গায় হবে না। মেপে নদের জায়গা বাদ দেওয়া হয়েছে। গুচ্ছগ্রামের পাশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হবে। তবে নিচু জায়গা ভরাট করে উঁচু করার জন্য নদ থেকে বালু তোলার কথা নয়। নদ থেকে বালু তোলার নিয়মও নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন। নদ থেকে বালু তুললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির বলেন, সরকারের একটি সংস্থা নদের জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করছে। এটা নদ–নদী রক্ষার পরিপন্থী। এর আগেও হরি নদের তীরে পাঁচটি সরকারি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্প বন্ধ করতে শিগগিরই আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।