সিয়ামুদ্দীনের বায়োস্কোপ খুবই ‘সাধারণ’, তবুও ‘মজা লাগে ভালো’

চলছে ঈদমেলা। সেখানে সিয়ামুদ্দীনের বায়োস্কোপ দেখতে ভিড় করেছে শিশুরা। গতকাল খুলনার মুজগুন্নি এলাকার শহীদ তিতুমীর মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

‘দাদার মজা লাগে ভালো, কিরণমালা এসে গেল, টাইটানিক জাহাজ দাদা সাগরেতে ভাসে, শাকিব খান আর অপু বিশ্বাস দেখো দাদা পাশে। শ্রাবন্তী এসে গেল—বাড়ি ভারতে, আর যাবে না ভারতে থাকবে বাংলাতে। দাদার মজা লাগে ভালো, কারবালার ময়দান সামনে এসে গেল, মক্কা শরিফ এসে গেছে সামনে দেখা যায়, হায়াত লেখা কপালে আর মউত লেখা পায়…’

ছন্দে ছন্দে মো. সিয়ামুদ্দীন সুর করে বলে চলেছেন। এক হাতে তাঁর খঞ্জনি বাজছে, আরেক হাত দিয়ে ঘুরছে বায়োস্কোপের চাবি। বাজনার তালে তালে নাচছে তাঁর পা দুটো। মাঝেমধ্যে বায়োস্কোপ বাক্সের ওপরের ছোট ছিদ্র দিয়ে ভেতরের দৃশ্যপট দেখে নিচ্ছেন।

খুলনা নগরের মুজগুন্নি এলাকার শহীদ তিতুমীর মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আয়োজিত ঈদ মেলায় এ দৃশ্য দেখা গেল। মেলা উপলক্ষে বায়োস্কোপ দেখাতে এসেছেন সিয়ামুদ্দীন। তাঁর বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার বগুড়া গ্রামে। জানালেন, তাঁর বয়স ৭০ ছাড়িয়েছে। চুল-দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে, দাঁতও পড়ে গেছে বেশ কয়েকটা। খণ্ডকালীন পেশা হিসেবে বায়োস্কোপ দেখানোর কাজ করলেও সিয়ামুদ্দীন মূলত একজন খেতমজুর।

কথায় কথায় জানা গেল, মাত্র সাত-আট বছর আগে থেকে তিনি বায়োস্কোপ দেখাচ্ছেন। তাঁর পাশের গ্রামের একজন বয়স্ক বায়োস্কোপওয়ালার সঙ্গে একসময় বিভিন্ন মেলায় যেতেন। বায়োস্কোপের রঙিন বাক্সটি সিয়ামুদ্দীন তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছেন। মাথায় বায়োস্কোপ নিয়ে গ্রামে ঘোরেন না সিয়ামুদ্দীন। খুলনার মুজগুন্নিতে দুই ঈদের মেলার সময় আর যশোর সাগরদাড়িতে মধুমেলায় বায়োস্কোপ দেখান তিনি। বাকি সময় পরের জমিতে খেতমজুরের কাজ করেন। তাঁর দুই মেয়ে, কয়েক বছর আগে তাঁদের বিয়ে দিয়েছেন।

ছবির সঙ্গে সঙ্গে খঞ্জনি বাজিয়ে ছন্দ মিলিয়ে ধারাবর্ণনা দেন সিয়ামুদ্দীন
ছবি: প্রথম আলো

একবারে ছয়জন দর্শক বায়োস্কোপ দেখতে পারেন। জনপ্রতি গুনতে হয় ১০ টাকা। গতকাল সোমবার বিকেলে সিয়ামুদ্দীনের বায়াস্কোপ বাক্সের আশপাশে ভিড় একেবারে কম ছিল না। বায়োস্কোপ দেখে শিশুরা ছিল উচ্ছ্বসিত। তাদের সঙ্গে বড়রাও দেখেছেন বায়োস্কোপ। অনেকে সামনে দাঁড়িয়ে তুলছিল সেলফি।

সিয়ামুদ্দীন জানান, বায়োস্কোপের সামনে ও দুই পাশে চোঙার মতো ছয়টি মুখ আছে। প্রতিটি মুখে লাগানো লেন্স। সেগুলো ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। বাক্সের ভেতর এক পাশে কাপড়ে লাগানো নানা ধরনের ছবি। আর কাপড় প্যাঁচানো দুইটা কাঠিতে। এর মধ্যে কাঠির ওপরের মাথায় বাক্সের বাইরে লাগানো থাকে দুটো হ্যান্ডেল বা চাবি। এই হ্যান্ডেল ঘোরালে ছবিসহ কাপড়টা এক পাশ থেকে অন্য পাশে প্যাঁচাতে থাকে। তখন চোঙায় চোখ লাগালে ছবিগুলো দেখা যায়। লেন্স থাকায় ছবিগুলো বড় ও স্পষ্ট দেখা যায়। ছবির সঙ্গে সঙ্গে খঞ্জনি বাজিয়ে ছন্দ মিলিয়ে চলে ধারাবর্ণনা।

নতুন করে এ পেশায় কেউ আসতেছে না। আমরা চলে গেলি এগুলো কেউ চালাবে না।
মো. সিয়ামুদ্দীন

কথাগুলো বলতে বলতে নিজেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন সিয়ামুদ্দীন। তিনি বলেন, আগে গ্রামের পথে পথে কাঁধে বাক্স নিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে বায়োস্কোপওয়ালা ঘুরতেন। সবাই তখন বায়োস্কোপ দেখে আনন্দ পেত। আগে বায়োস্কোপের কাহিনিতে থাকত ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসি’, ‘ইন্দিরা গান্ধী’, ‘মনোরম ফুলবাগান’, ‘মক্কা-মদিনা’, ‘আগ্রার তাজমহল’, ‘কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ’, ‘তিরবিদ্ধ রক্তাক্ত দুলদুল ঘোড়া’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’—এসব।

সিয়ামুদ্দীন জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে ছবিতে। সমস্যা হয়ে গেছে দেখানোর মতো ভালো ছবি এখন কিনতে পাওয়া যায় না। এ সময়ের দেশের ও ভারতীয় নায়ক-নায়িকা, মেসি, নেইমারের মতো বিশ্ববিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়, যমুনা সেতু—এসব যোগ করা হচ্ছে। তবে এখনো আছে আগের মক্কা-মদিনা, কারবালা, হাসান-হোসেনের ঘোড়া—এসব।

খুলনার বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী মুনতাসীর মাশফিক ও মারজুক শাহারিয়ার একসঙ্গে বায়োস্কোপ দেখছিল। দেখা শেষে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মুনতাসীর মাশফিক জানাল তার ভালো লাগার কথা, ‘মা-বাবার মুখে বায়োস্কোপের কথা অনেক শুনেছি। এখন তো এসবের তেমন দেখা মেলে না। ভেতরে তেমন কিছু না, তবে বায়োস্কোপ দেখতে পেয়ে মজা লাগছে।’

বোন ও বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে বায়োস্কোপ দেখছিলেন খালিশপুরের এক তরুণী গৃহবধূ নাজমুন-নাহার। তিনি বলেন, ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না’—গানটি অনেকবার শুনলেও বায়োস্কোপ সরাসরি উপভোগের সুযোগ আগে কখনো মেলেনি। বায়োস্কোপের ভেতরে নায়ক-নায়িকাসহ নানা কিছু দেখা গেল। খুবই সাধারণ বিষয়, তবে খুবই ভালো লেগেছে।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই বায়োস্কোপ। তারপরও কিছু মেলায় এখনো বায়োস্কোপওয়ালাদের দেখা মিলছে। তবে সেটা আর কত দিন, এ প্রশ্নের উত্তরে সিয়ামুদ্দীন বললেন, ‘নতুন করে এ পেশায় কেউ আসতেছে না। আমরা চলে গেলি এগুলো কেউ চালাবে না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে সিয়ামুদ্দীন বলেন, এ কাজে সম্মান নেই। আয়-রোজগারও খুব বেশি হয় না। আর বর্তমানে ঘরে ঘরে টেলিভিশন, হাতে হাতে মোবাইল আর ইন্টারনেটের কারণে বায়োস্কোপের কদর অনেক কমে গেছে।