কালো মেঘে যখন লিবিয়ার আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল, মামুন মিয়ার (২৮) তখন মনে পড়ল মায়ের কথা। এমন বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি রাঁধতেন মা। অভাবের সংসারে আট ভাই-বোন মিলে সেই খিচুড়ি তৃপ্তিভরে খেতেন। মায়ের সঙ্গে মামুনের স্থানিক দূরত্ব সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটারের। তাঁর হাতের রান্না খাবার যেহেতু সুযোগ নেই, তাই মাকে ফোন করে জেনে নেন কীভাবে রাঁধতে হয় খিচুড়ি। মা জানতে চান, খিচুড়ির সঙ্গে রান্নার মতো মাংস আছে কি না। ছেলে উত্তর দেন, ঘরে ডিম আছে। দুর্যোগের আবহাওয়ায় ছেলের কথা বুঝতে সমস্যা হয় বৃদ্ধা আবেদা বেগমের। বাধ্য হয়েই ফোন রেখে দেন। এই ছিল ছেলের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা।
লিবিয়ায় হয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় যে ছয় বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর জানা গেছে, তাঁদের একজন নারায়ণগঞ্জের মামুন মিয়া। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভোলাব পুবের গাঁও এলাকার প্রয়াত তমিজ উদ্দিন ও আবেদা বেগমের ছেলে মামুন। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে চার বছর আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতে লিবিয়ায় যান। পাশের গ্রামের আরেক সহকর্মী সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে একই ভবনে থাকতেন। লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে মামুনেরও মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার মামুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁকে হারানোর শোকে বিলাপ চলছে পরিবারে। মামুনের বৃদ্ধ মা উঠানে বসে কাঁদছিলেন। পাশে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন মামুনের বোন সাথী আক্তার। মায়ের কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে নিজেই কান্না জুড়ে দিচ্ছিলেন।
বিলাপের সুরে নিজের জীবনসংগ্রামের কথা বলতে থাকেন বৃদ্ধ আবেদা বেগম। স্বামীর মৃত্যুর পর খেয়ে না-খেয়ে কীভাবে আট সন্তানকে বড় করেছেন, সেসব কথা। মামুনের বয়স তখন সাড়ে তিন বছর। তাঁর বাবা তমিজ উদ্দিন দিনমজুরির কাজ করতেন। নিজের দেড় শতাংশের ভিটায় ছনের ছাউনিতে আট ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতেন। শ্বাসকষ্টে ভুগে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি। আট সন্তানের ভার এসে পড়ে আবেদা বেগমের ওপর।
তমিজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর আবেদা ও তাঁর বড় দুই ছেলে-মেয়ে অন্যের বাড়িতে কাজে লেগে যান। কাজ না মিললে মানুষের কাছে হাত পেতে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতেন আবেদা। স্কুলে ভর্তি করেন সবার ছোট মামুনকে। পড়াশোনায় ঝোঁক ছিল মামুনের। দিনমজুরির পাশাপাশি গ্রামের কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন তিনি। স্নাতকের জন্য যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, তখনই কিডনিজনিত রোগে ভুগে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় মামুনের বড় বোনের। এরপর সংসারের ভাগ্য ফেরানোর আশায় দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন মামুন।
মামুনের স্বজনেরা জানান, গ্রামের এক দালালের মাধ্যমে সুদে নেওয়া প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে চার বছর আগে লিবিয়ায় যান মামুন। লিবিয়ার দারনা শহরে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন তিনি। তবে মজুরি মিলত না ঠিকঠাক। সুদসহ ঋণ ফেরত দিতে গিয়ে পরিবারের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেননি। মামুনের বিয়ের কথা ভাবছিল পরিবার। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলে প্রাণ হারান তিনি।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে গণমাধ্যমে মামুনের মৃত্যুর খবর শোনার পর তাঁর সহকর্মীদের মাধ্যমে মামুনের নিখোঁজ হওয়ার খবর নিশ্চিত হয় পরিবার। তবে তাঁর লাশের কী হয়েছে, সে কথা জানা নেই স্বজনদের।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে শোকে ক্লান্ত আবেদা বেগমকে উঠান থেকে ঘরে নেওয়ার চেষ্টা করেন স্বজনেরা। আবেদা যেন কোনোভাবেই উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। ঘরে যাওয়ার আগে মামুনের মৃত্যুর খবরে বাড়িতে আসা তাঁর সহপাঠীকে জড়িয়ে আবার বিলাপ জুড়েন এই মা। অন্ধকারাচ্ছন্ন টিনের ঘরটিতে গিয়েও সেই বিলাপ থামে না। বিছানায় পড়ে বিলাপ করেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন, যেখানে যেভাবে আছেন, তাঁর সন্তান যেন শান্তিতে থাকেন।