মনোনয়ন নিয়ে ৩ আসনে অসন্তোষ, এর মধ্যেই বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারণা

জামালপুরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে দিন দিন উত্তাপ বাড়ছে। জেলার পাঁচটি আসনেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। তবে তিনটি আসনে মনোনয়ন নিয়ে দলীয় অসন্তোষ প্রকাশ্যে এসেছে। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কোথাও বিক্ষোভ, কোথাও অবরোধের মধ্যেই বিএনপির প্রার্থীরা কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে মাঠে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে বিরোধ না থাকায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা–কর্মীরা পাঁচটি আসনেই দলীয় প্রার্থীদের নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রার্থী ঘোষণা করে আগে থেকেই প্রচারে নেমেছে ইসলামী আন্দোলনও। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জেলার সব কটি আসনে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বললেও মাঠে দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। তবে জামালপুর-৩ আসনে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব লুৎফর রহমান প্রচার চালাচ্ছেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তিনটি আসনে এবং গণ অধিকার পরিষদ তিনটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু মাঠে দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় মাঠে নেই আওয়ামী লীগ। এখন পর্যন্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা নেই জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। কেন্দ্র থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা জাপার আহ্বায়ক জাকির হোসেন খান।

জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ)

কেন্দ্রীয় বিএনপির কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতকে আসনটিতে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, রশিদুজ্জামান ছাড়াও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কাইয়ুমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বকশীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদার ইতিমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

আব্দুর রউফ বলেন, ‘জনগণ আমাকে চারবার ভোট দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। আমিও সব সময় জনগণের পাশে ছিলাম। এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে এই আসনের মানুষের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

তবে এম রশিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। তিনি যে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা না দেবেন, সেই পর্যন্ত তাঁকে প্রার্থী বলা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা ধানের শীষ প্রতীকের বাইরে গিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীরা কখনোই ভোট দেবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি। আর এই কারণেই ভোটে কোনো ধরনের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।’

এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী কেন্দ্রীয় কমিটির মজলিশে শুরা সদস্য নাজমুল হক (সাইদী)। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আব্দুল মজিদ। এনসিপি থেকে এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী বকশীগঞ্জ উপজেলা শাখার প্রধান সমন্বয়কারী মোসাদ্দেকুর রহমান।

জামালপুর-২ (ইসলামপুর)

আসনটিতে ইসলামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সুলতান মাহমুদকে (বাবু) প্রার্থী করেছে দল। তবে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সড়কে আগুন দিয়ে অবরোধ, কাফনের কাপড় পরে সড়ক অবরোধ, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি করছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ এস এম আবদুল হালিমের অনুসারীরা। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের ছোট ভাই শরিফুল ইসলাম খানও এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপজেলা শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের শত শত মানুষ আমাকে ভালোবেসে মনোনয়ন পরিবর্তের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন। দলীয় মনোনয়নের তালিকায় আমার নাম না থাকায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে পুনর্বিবেচনা হলে আমি মনোনয়ন পেতে পারি।’

বিক্ষোভের বিষয়ে বিএনপির প্রার্থী সুলতান মাহমুদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সামিউল হক ফারুকীকে এখানে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি ও তাঁর নেতা–কর্মীরা নিয়মিত দলীয় কর্মসূচির পাশাপাশি ভোট চাইতে মানুষের কাছে যাচ্ছেন। এখানে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী সুলতান মাহমুদ সিরাজী। আর গণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী মো. ইসমাঈল হোসেন।

জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ)

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সহসম্পাদক মো. মোস্তাফিজুর রহমান (বাবুল) জামালপুর–৩ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশী আরও তিন নেতার অনুসারীরা বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে পৃথকভাবে সড়ক অবরোধ–বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা হলেন মাদারগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ফায়েজুল ইসলাম, সাবেক সচিব এ কে এম ইহসানুল হক ও মেলান্দহ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদিকুর রহমান।

বিক্ষোভের বিষয়ে বিএনপির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘২৫ বছর ধরে আমি মানুষের পাশে আছি। মানুষকে ছেড়ে যাইনি। আগামী নির্বাচনে মানুষ আমাকে ছেড়ে যাবেন না। অল্প কিছু মানুষ কিছু সুবিধার জন্য এসব করছেন। সেটা এখন নাই। দলীয় সব নেতা-কর্মী নির্বাচনী কাজে মাঠে রয়েছেন।’

এখানে জামায়াতের প্রার্থী জামালপুর জেলা শাখার কর্মপরিষদ সদস্য মজিবুর রহমান (আজাদী)। ইসলামী আন্দোলন জাহিদুল ইসলামকে এবং সিপিবির হাসান হাফিজুর রহমানকে আসনটিতে প্রার্থী করেছে।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব লুৎফর রহমানও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এলাকায় প্রচারে আছেন। তিনি বলেন, ‘জামালপুরের পাঁচটি আসনেই একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। তাঁদের যাচাই-বাছাই চলছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জামালপুরের পাঁচটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। অন্য আসনগুলোতে হয়তো দৃশ্যমান নির্বাচনী কর্মকাণ্ড লক্ষ করা যাচ্ছে না। তবে মনোনয়ন দেওয়ার পর সবাই নির্বাচনী মাঠে নেমে যাবেন।’

জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী)

জামালপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মো. ফরিদুল কবীর তালুকদার শামীম আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি–কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে প্রচার–প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে গণসংযোগ করে আসছিলেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদারের মেয়ে সালিমা তালুকদার আরুণী। দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর তিনি আর প্রচারে অংশ নেননি।

আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী দলের জেলা শাখার সেক্রেটারি মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল। তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে হাটবাজারসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে যে পরিমাণ সহযোগিতা ও ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করছেন, তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তাঁদের শঙ্কা মানুষ স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতে পারবে কি না? কারণ, দেশের একটি বৃহৎ দল প্রচারণার কাজে বাধা সৃষ্টি করছে।

এখানে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মো. আলী আকবর সিদ্দিক। এ ছাড়া এখানে গণ অধিকার পরিষদের মো. ইকবাল হোসেন ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মাহবুব জামানকে প্রার্থী করা হয়েছে।

জামালপুর-৫ (সদর)

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ওয়ারেছ আলী মামুনকে সদরের আসনটিতে প্রার্থী করেছে দলটি। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সহসম্পাদক নিলুফার চৌধুরী (মনি)। এই আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর কোথাও অসন্তোষ দেখা যায়নি। একক প্রার্থী হিসেবে শাহ মো. ওয়ারেছ আলী নেতা-কর্মীদের নিয়ে শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন।

শাহ মো. ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে টানা ১৭ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেননি। সাধারণ মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছেন। ১৭ বছর বিএনপি মানুষের পাশেই ছিল। এই কারণে মানুষ মনেপ্রাণে ধানের শীষে ভোট দিতে চান।’

জামায়াতের জেলা শাখার আমির আবদুস সাত্তারকে প্রার্থী করেছে জামায়াত। তিনি কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এখানে ইসলামী আন্দোলনের মুফতি মোস্তফা কামাল ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আক্কাসকে প্রার্থী করেছে। এ ছাড়া এখানে গণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী জাকির হোসেন।