যমুনার ভাঙনে নিঃস্ব তাঁরা

নদীভাঙনের শিকার অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেক পরিবার অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে।

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানী ইউনিয়নের খোলাবাড়ি এলাকায় যমুনার ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব তাঁরা। সম্প্রতি খোলাবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে সংসার ছিল বাহেলা বেগমের (৬০)। সংসারে ছিল সচ্ছলতা। নদীভাঙনের কারণে তাঁর সেই সংসার এখন তছনছ। ১ বা ২ বার নয়, ১৩ বার যমুনার ভাঙনের শিকার হয়েছে তাঁর বসতভিটা। এখন ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যের জমিতে আশ্রয় হয়েছে তাঁর।

যমুনার ভাঙনে বাহেলার মতো জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানী ইউনিয়নের খোলাবাড়ী এলাকার দুই শতাধিক পরিবার সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকছে অন্যের জমি ভাড়া করে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বলেন, নদীভাঙনের শিকার হওয়া অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেকে আবার অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে। কিছু কিছু পরিবার রাস্তার পাশে ছাপরা তুলে থাকছে। এলাকায় তেমন কোনো কাজকর্ম না থাকায় পরিবারগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাঁদের দাবি, এ এলাকায় ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক। আর প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি করে ঘর প্রতিটি পরিবারকে বরাদ্দ দেওয়া হোক।

বাহেলা বেগমের স্বামীর বাড়ি ছিল ইসলামপুর উপজেলার বেলগাছা এলাকায়। সংসারে কৃষিজমি, গবাদিপশুসহ সবই ছিল। প্রায় ২৫ বছর আগে এক রাতের মধ্যে যমুনা নদী সব কেড়ে নেয়। তারপর দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ফুটানিবাজার এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করেন। কয়েক বছরের মধ্যে সেখানেও ভাঙন হানা দেয়। তারপর ডাকের চর এলাকায় আসেন। সেখানেই আটবার ঘরবাড়ি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়েছেন। এর মধ্যে স্বামীর মৃত্যু হয়। পরে সন্তানদের নিয়ে খোলাবাড়ীতে চলে আসেন। খোলাবাড়ী এলাকাতেও তিনবার ভাঙনের শিকার হন। তিনি বলেন, ‘সব হারায়ে মানুষের বাড়িতে কাজকাম কইরা খাই। আবার সিজনে মরিচ উঠাই, ভুট্টা তুলি, মাটি কাটার কামলা দেই, খেতা (কাঁথা) সিলেই (সেলাই) করি। এমনে কইরা বাঁইচ্চা আছি। আমগরে এহানে একটা শক্ত বাঁধ চাই আর একটা ঘর চাই।’

সম্প্রতি খোলাবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীভাঙন এখন বন্ধ। তবে ভাঙনের চিহ্ন আশপাশে ছড়িয়ে আছে। পাকা সড়ক ভেঙে পড়ে আছে। বসতভিটার গাছপালা ভেঙে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। একসময়ের বিশাল খোলাবাড়ী বাজার এখন নেই। সেখানে এখন বালুর চর।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বলেন, খোলাবাড়ী এলাকার অর্ধেক অংশ প্রতিবছর বন্যা ও ভাঙনে যমুনার গর্ভে চলে গেছে। খোলাবাড়ী এলাকায় ছিল বিশাল বাজার। আরও ছিল কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তিন শতাধিক বসতবাড়ি, শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শত শত একর ফসলি জমি—সব এখন নদীগর্ভে। এলাকায় চর পড়েছে। প্রায় ২০ বছর ধরে এই ভাঙন চলছে। এই ভাঙন একসময় প্রায় তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে ছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা না হলে খোলাবাড়ীর অবশিষ্ট অংশটুকুও আগামী বছরের বর্ষার মধ্যে নদীগর্ভে চলে যাবে।

চিকাজানী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ নানা জায়গায় কথা বলেছেন তিনি। আগামী বর্ষার আগেই ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। আর নদীভাঙনে ভূমিহীন মানুষদের যেন একটি করে ঘর করে দেওয়া হয়, এই বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন।

দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন্নাহার শেফা জানিয়েছেন, নদীভাঙনের শিকার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে অনেকেই ঘর পাচ্ছেন। এখনো ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ঘরের নির্মাণকাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে তাঁদের ঘর দেওয়া হবে।

পাউবো জামালপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জয়ন্তু পাল বলেন, খোলাবাড়ী এলাকার ভাঙনরোধে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলছে। সমীক্ষার সুপারিশ অনুযায়ী ওই এলাকার ভাঙনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।