১২ হাজার নলকূপে উঠছে লোনাপানি, খাবার পানির সংকটে কুতুবদিয়ার দেড় লাখ মানুষ

কুতুবদিয়ার হাজি মফজল মিয়া পাড়ার এই একটি গভীর নলকুপের পানি দিয়ে চাহিদা পূরণ কৈয়ারবিল ইউনিয়নের সব বাসিন্দার। সম্প্রতি তোলা
ছবি-প্রথম আলো

কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার ছয়টি ইউনিয়নে নলকূপ আছে ২১ হাজার। এর মধ্যে অন্তত ১২ হাজার নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। কয়েকটি ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এতই নিচে নেমে গেছে যে ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরে গিয়েও সুপেয় পানির সন্ধান মিলছে না।

উপজেলা প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, ১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের চতুর্দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ আছে ৪০ কিলোমিটার। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে সমুদ্রের লোনাজলের আগ্রাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমানে দ্বীপে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানির চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে লোকজন পুকুর-জলাশয় এবং ডোবার লবণমিশ্রিত পানি খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার।

একটি নলকূপে ভরসা পুরো ইউনিয়ন

উপজেলার মধ্যভাগে কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের হাজি মফজল মিয়া পাড়া। পাড়ার মধ্যভাগে একটি মসজিদের পাশে রয়েছে একটি গভীর নলকূপ। ৭৮০ ফুট গভীরে মিলেছে সুপেয় পানি। এই একটি নলকূপের পানি দিয়ে চলে পুরো ইউনিয়নের চাহিদা।

হাজি মফজল মিয়া পাড়ার বাসিন্দা আলী হোসেন পেশায় জেলে। বাঁশ ও ত্রিপলের ছাউনির ঘরে থাকেন স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে। নলকূপের পাশেই তাঁর বাড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আলী হোসেন বাড়ির সামনে লম্বা লাইন দেখতে পান। গভীর রাত পর্যন্ত থাকে এই ভিড়। ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন আসেন নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করতে।

সম্প্রতি এই এলাকায় গেলে আলী হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পুরো ইউনিয়ন লন্ডভন্ড হয়। মারা গেছেন এই ইউনিয়নের অন্তত সাত হাজার মানুষ। এরপর থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। নলকূপের পানি লবণাক্ত হতে শুরু করে। গত ৩২ বছরে এই গ্রামের ৯০ শতাংশ নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। এই একটি নলকূপে মিষ্টি পানি পাওয়া যায়। সে কারণে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষ কলসি, প্লাস্টিকের গ্যালন আর বালতি নিয়ে লাইন ধরে দাঁড়ান পানি নিতে।  

একই কথা বলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (৭০)। ১২ বছর আগে তাঁর বাড়ির নলকূপে লবণ–পানি দেখা দেয়। এরপর কয়েক বছর পুকুরের পানি খেয়েছেন, এখন মফজল মিয়া পাড়ার ওই গভীর নলকূপের পানি পান করছেন তিনি।

৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মীর কাশেম (৩৮) প্রথম আলোকে বলেন, ৪ নম্বর এবং পাশের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে নলকুল আছে ৭০০টির বেশি। ৯০ শতাংশ নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ৮০০ থেকে ১ হাজার ১৫০ ফুট গভীরে গিয়েও মিষ্টি পানি পাওয়া যাচ্ছে না। মফজল পাড়ার গভীর নলকূপটি দিয়েই পূরণ হচ্ছে পুরো ইউনিয়নের চাহিদা।

কুতুবদিয়ার ঘরে ঘরে খাবার পানি পৌঁছে দেন ভ্যান চালকেরা। গত কয়েক বছরে বেড়েছে খাওয়ার পানির ব্যবসা। উপজেলার লেমশিখালী ইউনিয়নের জাহাজঘাটা এলাকা। সম্প্রতি তোলা
ছবি-প্রথম আলো

ভ্যানগাড়িতে করে খাবার পানি সরবরাহ

দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় চোখে পড়ে ভ্যানগাড়িতে করে ঘরে ঘরে খাবার পানি সরবরাহের দৃশ্য। লেমশিখালী ইউনিয়নের স্টিমারঘাট এলাকায় ভ্যানগাড়িতে খাবার পানি সরবরাহ করছিলেন স্থানীয় নুরুল বশর। তাঁর ভ্যানগাড়িতে ২০টি পানিভর্তি প্লাস্টিকের গ্যালন।

নুরুল বশর (৫০) বলেন, প্রতি গ্যালনে ৫০ লিটার পানি ধরে। গ্রামের কয়েকটি নলকূপে মিষ্টি পানি পাওয়া যায়। সেখান থেকে গ্যালনে পানি ভরে তিনি ঘরে ঘরে বিক্রি করেন। প্রতি গ্যালন পানির দাম ২০ টাকা। দৈনিক তিনি সর্বোচ্চ ৫০০ গ্যালন পানি সরবরাহ দেন। উপজেলার উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশিখালী, কৈয়ারবিল, বড়ঘোপ, আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নে সুপেয় পানি সরবরাহের এমন ভ্যানগাড়ি আছে দুই শতাধিক।

আলী আকবর ডেইল ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিকদার বলেন, প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের এই ইউনিয়নে নলকূপ আছে ৩ হাজার। এর মধ্যে অন্তত ২ হাজার নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ১ হাজার ফুট নিচে গিয়ে সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বড়ঘোপ ইউনিয়নের ৪ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মলমচরসহ কয়েকটি গ্রামে ২ হাজার ফুট নিচে গিয়েও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বীপের যেসব নলকূপের পানি কিছুটা লবণাক্ত, সেই পানি পরিশোধন করে খাওয়ার উপযোগী করা যায়। তাতে প্রতি লিটারে খরচ হয় ১ টাকার বেশি।

কিন্তু লোকজনের সেই টাকা নাই বলে পুকুর-জলাশয় ও ডোবার পানি ব্যবহার করে নানা রোগশোকে আক্রান্ত হচ্ছেন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, উপজেলাতে ২১ হাজার নলকূপ থাকলেও এক যুগের বেশি সময় ধরে ৯০ শতাংশ নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ নলকূপের পানি শুকিয়ে গেছে।

খাওয়ার পানির বিকল্প ব্যবস্থা

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খাওয়ার পানির সংকট দূরীকরণে সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ২৬টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। ১৬০ ফুট গভীরতার প্রতিটি নলকূপ স্থাপনের বিপরীতে খরচ হয় ২৮ হাজার টাকা।

গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয় আরও ১০৪টি। নলকূপগুলোর গভীরতা ৮০০ থেকে ১ হাজার ফুট। উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের নলকূপগুলো ১ হাজার ফুট নিচে, দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের নলকূপ ৭৬০ ফুট এবং বড়ঘোপ ইউনিয়নের নলকূপ ৮৫০ ফুট নিচে যেতে হয়েছে। প্রতিটি গভীর নলকূপ স্থাপনের বিপরীতে খরচ হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা করে।

উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আল আমিন বলেন, শহরের সুবিধা গ্রামে এই প্রকল্পের আওতায় পাইপলাইনের মাধ্যমে কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মলমচরে খাওয়ার পানি সরবরাহ দিতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

একইভাবে বড়ঘোপ ইউনিয়নে ১০ কিলোমিটার পাইপলাইন, কৈয়ারবিলে ১৩ কিলোমিটার, লেমশিখালীতে ১২ কিলোমিটার, দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নে ৭ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে অন্তত ২ হাজার পরিবারে খাওয়ার পানি সরবরাহের প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৮ কোটি টাকার মতো। আগামী ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঘরে ঘরে সুপেয় পানি পৌঁছে যাবে। তখন সংকট কিছুটা নিরসন হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থসহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।

এ ছাড়া উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রকল্প-নামে ২ কোটি ৭২ লাখ ৭০ টাকার পৃথক আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এই প্রকল্প অনুযায়ী লেমশিখালীতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে অন্তত ৬০৬টি পরিবারে খাবার পানি সরবরাহ হবে।