বর্ষা সামনে রেখে নৌকা তৈরি ও মেরামতের ধুম 

১৬ রুটে যাত্রী ও পণ্যবাহী প্রতিদিন অন্তত ১৫০টি যাত্রীবাহী ও ১০০টি পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করে। চরাঞ্চলের প্রধান বাহন নৌকা।

যমুনা নদীর তীরে নৌকা তৈরি ও মেরামতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কারিগরেরা। সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কালিতলা গ্রোয়েন এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে। বর্ষাকালের আগেই যমুনাপারের এই জনপদে নৌকা তৈরির কাজ শেষ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগরেরা। চলছে পুরোনো নৌকা মেরামতেরও কাজ।

সারিয়াকান্দির কালীতলাঘাট ও মথুরাপাড়া ঘাট থেকে প্রতিদিন জামালপুরের মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, গুঠাইল, কাজীপুরের নাটুয়াপাড়া, গাইবান্ধার সাঘাটা ছাড়াও ওপারের কাজলা, জামথল, বোহাইল, মানিকদাইড়, চরঘাগুয়া, ডাকাতমারা, বোহাইল, ধারাবর্ষাসহ ১৬ রুটে যাত্রী ও পণ্যবাহী প্রতিদিন অন্তত ১৫০টি যাত্রীবাহী নৌকা ও ১০০টি পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করে। এর বাইরে চরাঞ্চলের মানুষের ঘরে ঘরে আছে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা। তাঁরা এসব নৌকায় খেতের পণ্য বাজারে নেন, কেউ বর্ষাকালে মাঝ যমুনায় নৌকা থেকে জাল ফেলে মাছ ধরেন। এক চর থেকে অন্য চরে চলাচল ছাড়াও খেয়া পারাপারে প্রধান বাহন এখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা।

শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতাসংকটে সব রুটেই যাত্রী ও পণ্য পারাপার সীমিত হয়ে পড়েছিল। বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে কারিগরদের ডেকে এসব পুরোনো নৌকা মেরামত করছেন কেউ কেউ। কেউ আবার খেয়া পারাপারের জন্য নতুন নৌকার ফরমাশ দিচ্ছেন কারিগরদের কাছে।

গত রোববার সকালে সারিয়াকান্দি সদরের কালিতলা খেয়াঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কারিগরদের মধ্যে নতুন নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে। কেউ আবার পুরোনো নৌকা মেরামত করে আলকাতরা লাগাচ্ছেন। সারিয়াকান্দি সদরের আনগড়বাড়ি গ্রামের নৌকার কারিগর শহীদুল ইসলাম ওরফে নান্নুর বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। চারজন সহকারীকে নিয়ে নদীপাড়ে ৪৫ হাত দৈর্ঘ্যের একটি নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। 

শহীদুল ইসলাম বলেন, বাপ-দাদা টিনের ছাউনির মিস্ত্রির কাজ করতেন। শৈশবে তিনিও এ কাজ করেছেন। এখন টিনের ছাউনির কাজ কমেছে। পেশা বদলে নৌকা তৈরির কাজে ঝুঁকেছেন। বর্ষাকালের আগে মে ও জুন মাসে নৌকা তৈরির কাজ হয়। বছরের অন্য সময় টুকটাক টিনের ছাউনি তোলার কাজ করেন। সময়-সুযোগ পেলে নৌকা নিয়ে যমুনায় মাছ ধরতেও যান।

কারিগর শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, তিন-চারজন সহকারীকে নিয়ে বড় নৌকা তৈরি করতে ৮-১০ দিন সময় লাগে। প্রতি হাত ১ হাজার টাকা হারে নতুন নৌকা তৈরির মজুরি নেন। নৌকার কাঠ থেকে শুরু করে যাবতীয় মালামাল কিনে দেন মাঝি ও মহাজনেরা।

পাশেই একটি পুরোনো নৌকা মেরামত করছিলেন সারিয়াকান্দি সদরের বাগবেড় গ্রামের ফজল মণ্ডল (৬০)। তিনি বলেন, পুরোনো নৌকা মেরামতের কাজ হয় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে। তিনবেলা খাওয়াসহ কারিগরদের মজুরি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা।

 সারিয়াকান্দি উপজেলার কুপতলা গ্রামের কারিগর সামছুল ইসলাম (৫০) বলেন, কালিতলাঘাট ছাড়াও দীঘলকান্দি, মথুরাপাড়া, রোহদহ, হাসনাপাড়া, পাকুল্যা, জামথল, নান্দিনার চর, বহাইল, ধারাবর্ষাসহ বিভিন্ন স্থানে শতাধিক কারিগর নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

নৌকা তৈরির কাজ দেখা গেল যমুনাপারের জনপদ মথুরাপাড়া হাটেও। এ হাটে নদীপাড়ে যেতে শোনা যায় ঠুকঠাক শব্দ। নৌকার কারিগর জয়নাল শেখ বলেন, যমুনা নদীঘেঁষা এ ঐতিহ্যবাহী হাটে প্রতি হাটবার জমে ওঠে নৌকা বেচাবিক্রি। বর্ষা ঘনিয়ে আসতে না আসতেই এ হাটে বেচাকেনা জমে ওঠে। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত চলে নৌকার বেচাকেনা। অন্যবারের তুলনায় এবার চাহিদা বেশি, কারিগরদের মধ্যে ব্যস্ততাও বেশি। 

নৌকার কারিগরেরা বলেন, বর্ষাকালে নৌকা ও বছরের বাকি সময় কাঠমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চলে তাঁদের। আগে ডিঙ্গির চাহিদা ছিল বেশি। এখন শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা তৈরি হয় বেশি। আকারভেদে প্রতিটির দাম ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা। নৌকা তৈরিতে সাধারণত কড়ই, হিজল, মেহগনি ও কাঁঠাল কাঠ ব্যবহৃত হয়। কাঠ ছাড়াও আলকাতরা, রং, তারকাটা, গজাল, পাতাম ও লোহার প্রয়োজন হয়। 

সারিয়াকান্দি পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান বলেন, যমুনা নদীতে পানি বাড়তেও শুরু করেছে। চরাঞ্চলবেষ্টিত কাজলা, কর্নিবাড়ি, বহাইল, চালুয়াবাড়ি ও হাটশেরপুর ছাড়াও বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বসবাসকারী চরাঞ্চলের লোকজনের চলাচলের ভরসা ইঞ্জিনচালিত নৌকা। প্রতিদিন ৮-১০ হাজার যাত্রী পারাপার হন।