যশোরে ১৩ দিনে ১২ ‘গায়েবি’ মামলা, আসামি ৯৫০

যশোর জেলার মানচিত্র

সরকার উৎখাত ও নাশকতার অভিযোগে অক্টোবর মাসের প্রথম ১৩ দিনে বিশেষ ক্ষমতা আইনে যশোরে ১২টি মামলা হয়েছে। জ্ঞাত ও অজ্ঞাত মিলিয়ে এসব মামলায় ৯৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১০৫ জন। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন।

যশোরের কোতোয়ালি থানায় তিনটি, বাঘারপাড়া, চৌগাছা ও ঝিকরগাছায় দুটি করে এবং শার্শা, বেনাপোল ও অভয়নগরে একটি করে মামলা হয়েছে। গত ২৪ থেকে ২৬ অক্টোবর সব কটি মামলার ঘটনাস্থল ঘুরে, সাক্ষী, আসামি ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সবকটি ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। মামলার সাক্ষীদের অনেকে ঘটনা সম্পর্কে জানেন না। ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসিন্দারা এজাহারে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী কিছুই দেখেননি; নাশকতামূলক কিছুই তাঁরা জানেন না।

বিএনপির নেতাদের দাবি, সবগুলো ‘গায়েবি’ মামলা। ঘটনা ঘটেনি, তারপরও মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব মামলার বিবরণ একই রকম। নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা–কর্মীদের ‘চাপে রাখতে’ কথিত এসব মামলা দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। এর আগে জামালপুরে ৩৬ দিনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০টি ‘গায়েবি’ মামলা করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সৈয়দ সাবেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে বাধা দিতে পুলিশকে দিয়ে সরকার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা দিচ্ছে। সরকার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা দিয়ে মনোবল ভাঙার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ঘটনা না ঘটলেও পুলিশ নাটক সাজিয়ে নেতা-কর্মীদের হয়রানি করছে।

যশোর জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হচ্ছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও নিয়মিত মামলার আসামিদেরই আটক করা হচ্ছে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।

সাক্ষী কিছুই জানেন না

বেনাপোল বন্দর থানা পুলিশের করা একটি মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় বেনাপোল থানার পোড়াবাড়ী বাজারের ইন্তাজের চায়ের দোকানের পেছনে আমবাগানে সরকার উৎখাত ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করতে পেট্রলবোমা ও রড নিয়ে সংঘবদ্ধ লোকজন অপেক্ষা করছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে আসামিরা পালিয়ে যান। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ওসমান আলী (৪০) ও ইমদাদুল হককে (৫০) আটক করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ককটেলসদৃশ পাঁচটি বোমা, লোহার রড, বাঁশের লাঠি জব্দ করা হয়।

 বেনাপোল বন্দর থানার উপপরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাটি করেন। মামলায় ৩৪ জনের নাম উল্লেখের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার সাক্ষী হিসেবে এজাহারে পোড়াবাড়ী গ্রামের সুমন রহমান ও আনিছুর রহমানের নাম আছে। তাঁদের মধ্যে সুমন বিট পুলিশিং কার্যালয়ের অফিস সহকারী এবং আনিছুর ইজিবাইক চালক।

২৫ অক্টোবর ইন্তাজ আলীর চায়ের দোকানে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। মামলার কথা শুনে চায়ের দোকানে বসা সবাই বিস্মিত হন। তাঁদের ভাষ্য, চায়ের দোকানের পেছনে আমবাগানে ওই দিন বিএনপি-জামায়াতের লোকজন জড়ো হননি। ঘটনার দিন ইন্তাজের চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন ওসমান ও ইমদাদুল। পুলিশ অতর্কিতে এসে তাঁদের আটক করে নিয়ে যায়। স্থানীয় শহিদুল ইসলাম বলেন, মামলায় যেসব কথা বলা হয়েছে, তার কিছুই সেদিন এখানে ঘটেনি। যাঁদের পুলিশ সেদিন ধরেছে, তাঁরা বিএনপির রাজনীতি করেন।

মামলার সাক্ষী আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাই। কাজ শেষে প্রতিদিন বিট পুলিশিং অফিসে বসে সময় কাটাই। সেদিনও অফিসে ছিলাম। হঠাৎ বন্দর থানার সেকেন্ড অফিসার একটা কাগজ দিয়ে বললেন, “এখানে একটা সই কর।” আমি ঘটনার কিছুই জানি না। কিন্তু পুলিশের কথামতো সই করে দিলাম। পরে দেখি আমি মামলার সাক্ষী।’

জানতে চাইলে বেনাপোল বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন ভুইয়া বলেন, ‘মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিষয়টি বলতে পারব।’

আহত নেতাকে দেখতে গিয়ে ধরা

গত ১ অক্টোবর শার্শা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান ওরফে জহির সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী হন। চিকিৎসকের পরামর্শে শার্শার দক্ষিণ বুরুজবাগান গ্রামে নিজ বাড়িতে বিশ্রামে ছিলেন তিনি। খবর পেয়ে নেতা–কর্মীরা তাঁর বাড়িতে যান। সেখানে পুলিশ গিয়ে নয়জনকে আটক করে। এ ঘটনায় শার্শা থানার উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ২৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৪০ থেকে ৪৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। আবুল হাসান মামলার ১০ নম্বর আসামি।

মামলার এজাহারে বলা হয়, সরকার উৎখাত ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে ষড়যন্ত্রের জন্য বিএনপির নেতা–কর্মীরা ককটেল, লাঠিসোঁটা, লোহার রড নিয়ে আবুল হাসানের বাড়ির উঠানে গোপন বৈঠক করছিলেন। তখন পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নয়জনকে আটক করে। অন্যরা পালিয়ে যায়।

২৫ অক্টোবর দক্ষিণ বুরুজবাগান গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, ঘটনার পর থেকে আবুল হাসান এলাকাছাড়া। বাড়িতে অনেকটা সুনসান নীরবতা। আবুল হাসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে বিশ্রামে ছিলাম। নেতা–কর্মীরা আমাকে দেখতে গেলে পুলিশ এসে নয়জনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে নাশকতার মামলা দিয়ে ২৮ জনকে আসামি করে। আমরা ১৮ জন হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছি।’

বিস্ফোরণের শব্দ শোনেনি কেউ কেউ

নাশকতার অভিযোগে ৫ ও ১৩ অক্টোবর বাঘারপাড়া থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। ৫ অক্টোবরের মামলায় ৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এজাহারে বলা হয়, বাঘারপাড়ার বন্দবিলা ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে চিত্রা নদীর নবনির্মিত সেতুটি ধ্বংসের জন্য বিএনপির উচ্ছৃঙ্খল নেতা–কর্মীরা অস্ত্র, গুলি, বোমা ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেতুর ওপর অবস্থান করছে।

পুলিশ ঘটনাস্থলের সন্নিকটে পৌঁছামাত্রই আসামিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে আকস্মিকভাবে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ করে দিগ্‌বিদিক পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মথুরাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চিত্রা নদীর ওপর নতুন একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। নাম খাজুরা সেতু। সেতুর পূর্ব পাশে মথুরাপুর ও পশ্চিমে ধর্মগাতী গ্রাম। নদীর পূর্ব পাড়ে খাজুরা বাজার। ধর্মগাতী গ্রামের নিরঞ্জন দাস বলেন, ৫ অক্টোবর রাতে তিনি বাড়িতেই ছিলেন। ওই রাতে তিনি বিস্ফোরণের কোনো শব্দ শুনতে পাননি। তিনি আটটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

মামলার সাক্ষীদের দুজন খাজুরা বাজারের নৈশপ্রহরী। তাঁদের একজন পিকুল হোসেন বলেন,‌ ওই রাতে তিনি খাজুরা বাজারে ডিউটিতে ছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে পরপর দুটি শব্দ শুনতে পান। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন পুলিশ এসে তাঁকেসহ অন্য দুজন নৈশপ্রহরীকে ডাক দেয়। তাঁরা সেতুর কাছে গিয়ে কিছু জালের লোহার কাঠি দেখতে পান। তবে সেখানে কোনো লোকজন দেখেননি।

খাজুরা বাজারে একটি ওষুধের দোকান আছে মোজাফফর হোসেনের। তাঁকে ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে। তিনি বিএনপির রাজনীতি করেন। তিনি বলেন, ৫ অক্টোবর রাতে তিনি দোকান বন্ধ করে বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন সকালে বাজারে এসে জানতে পারেন, নাশকতার মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার অভিযোগ

১৩ অক্টোবর একই ধরনের বর্ণনায় ৪৭ জনের বিরুদ্ধে বাঘারপাড়া থানায় আরেকটি মামলা করে পুলিশ। এজাহারে বলা হয়, বাঘারপাড়া পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের পাশে জনৈক তাহের সিদ্দিকীর মেহগনিবাগানে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি ধ্বংস করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীরা অস্ত্র, গুলি, বোমা ও দেশি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবস্থান করছিল।

পুলিশ ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছামাত্রই আসামিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের দিক থেকে আকস্মিকভাবে পরপর তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিগ্‌বিদিক পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সরেজমিনে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের পাশে তাহের সিদ্দিকীর মেহগনিবাগানে দেখা গেছে, একটি পতিত জমি। কোনো মেহগনিগাছ নেই। জমির এক পাশে নিচু করে বাঁশ বেঁধে গোবর শুকাতে দেওয়া হয়েছে। মামলায় পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের দুজন কর্মচারীকে সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে তাঁরা রাজি হননি।

মহিরণ গ্রামের গৃহবধূ শুকুরন বেগম বলেন, ‘রাতে বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলাম। রাত একটার দিকে তিনটি শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। দুটি শব্দ জোরে হয়, একটি কিছুটা আস্তে। রাতে আর ঘর থেকে বের হইনি। সকালে রাস্তার পাশে এক জায়গায় কিছুটা ঘাস মরে থাকতে দেখি। পরে পুলিশ আসে।’

বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শামছুর রহমান বলেন, দুটি মামলাই হয়রানিমূলক। এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। হয়রানির জন্য ঘটনা সাজিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। বাঘারপাড়া থানার ওসি মো. শাহাদাত হোসেন দাবি করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকেও কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।