পটুয়াখালীতে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, ৯০ টাকার স্যালাইন কিনতে হয় ১৩০ টাকায়

জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা না করায় গ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।  মশার লার্ভা ধ্বংসে গ্রাম পর্যায়ে অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে না।

এস এম কবির হাসান, সিভিল সার্জন, পটুয়াখালী

পটুয়াখালীতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় এবার বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গুতে গ্রামের মানুষও মারা যাচ্ছেন। সরবরাহ কম থাকায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য জরুরি আইভি স্যালাইনের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রত্যন্ত এলাকায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে না। গ্রাম এলাকায় এডিস মশার লার্ভা নিধনে অভিযান চালানো হচ্ছে না। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে গ্রামের লোকজন কিছুই জানেন না। এসব কারণে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

গত রোববার পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ২২টি শয্যা থাকলেও ১২৬ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। গত ১৮ দিনে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।

ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনায় করণীয় নিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সভা হয়েছে।
এস এম কবির হাসান, সিভিল সার্জন, পটুয়াখালী

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় হাসপাতালের পাশাপাশি স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে ওষুধের দোকানগুলোতেও। বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে রোগীর স্বজনদের অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। ওষুধের দোকানগুলোতে ৯০ টাকার স্যালাইন ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রোববার সকালে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু ওয়ার্ডে মেঝেতেও রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডের প্রবেশপথ, বারান্দাসহ পুরো ভবনের নিচতলায় ডেঙ্গু রোগী। এখানে শয্যার চেয়ে চার গুণ বেশি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসায় মশারি সরবরাহ করা হলেও রোগীদের মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

এদিকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় স্যালাইনের সরবরাহ পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন রোগীরা। হাসপাতালের প্রবেশপথে খোলা জায়গায় শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন রেহেনা বেগম নামের এক গৃহবধূ। জেলার সদর উপজেলার লাউকাঠি গ্রামের এই গৃহবধূ ৬ দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হন। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নেওয়া জ্বর কমলেও শরীর দুর্বল হতে থাকে। গত শনিবার এই হাসপাতালে নিয়ে এলে পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ভর্তি হন হাসপাতালে।

রেহেনা বেগমের মা বীথি বেগম জানান, এখানে দুই দিন ধরে তাঁরা আছেন। তবে হাসপাতালে তাঁরা স্যালাইন পাননি। বাইরে থেকে চারটি স্যালাইন কিনে এনে চিকিৎসা চলছে।

জেলা শহরের ব্যায়ামাগার এলাকার মো. ইউসুফ শনিবার বিকেলে এই হাসপাতালে আসেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে এখানেই ভর্তি হন তিনি। ইউসুফ জানান, ভর্তির পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে একটি স্যালাইন দিয়েছে তাঁকে। বাইরে থেকে দুটি কিনেছেন। স্যালাইনের দামও বেশি রেখেছেন বলে জানান।

সদর হাসপাতালে স্যালাইন পর্যাপ্ত রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত জুন মাসে স্যালাইনের সরবরাহ ছিল ৬০০ লিটার। ৫৫০ লিটার স্যালাইন রোগীদের দেওয়া হয়েছে। রোগী বাড়তে থাকায় আগস্ট মাসে অতিরিক্ত বরাদ্দ হিসেবে ৫ হাজার লিটার পাওয়া গেছে। গত রোববার পর্যন্ত ৪ হাজার লিটার পরিমাণ রোগীদের দেওয়া হয়েছে। তবে এখন রক্তের চাপ বাড়ানোর জন্য হার্টম্যান স্যালাইন-সংকট রয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর সব ধরনের পর্যাপ্ত স্যালাইন পাওয়া যাবে।

পটুয়াখালীর সদর উপজেলার ঢেউখালী গ্রামের গৃহবধূ রুবিনা আক্তার (২৭) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

রুবিনা বলেন, ‘আমরা গ্রামের মানুষ। এহন শুনি ডেঙ্গু মশা কামড়াইছে। ডেঙ্গু কী, এ নিয়া কেউ কিছু জানা নাই। বুঝিও না। এহন গ্রামেও জ্বর হইলে ডেঙ্গু মনে করে। পাঁচ দিন পর্যন্ত বাড়িতে ওষুধ খাইছি। জ্বর কমে নাই। তাই শনিবার এই হাসপাতালে ভর্তি হইছি। এখন কয় ডেঙ্গু হইছে।’

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক দিলরুবা ইয়াসমীন লিজা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমছে না বলে জানান। তিনি বলেন, প্রথমে ২২টি শয্যা দিয়ে ডেঙ্গু ওয়ার্ড শুরু করা হয়েছিল। পরে ৮০ শয্যা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। গত রোববার এখানে ১২৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। তিনি বলেন, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় আগেভাগেই পর্যাপ্ত স্যালাইন সরবরাহ করায় হাসপাতালে  স্যালাইন ও কিটের সংকট নেই।

সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে  কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) চিন্ময় হাওলাদার বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে পটুয়াখালী পৌরসভা থেকেও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। পৌরসভার আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা একরামুল নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে পৌরসভা থেকে সচেতনতামূলক লিফলেট, প্রতিটি ওয়ার্ডে উঠান বৈঠক, মশা নিধনের ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের পটুয়াখালী কমিটির সভাপতি রকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কারণে স্যালাইনের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা রয়েছে। তবে তাঁরা দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ব্যাগ পাচ্ছেন। সরবরাহ কম থাকায় স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে।

জেলা ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটির সদস্য পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন এস এম কবির হাসান বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনায় করণীয় নিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সভা হয়েছে। তবে বর্তমানে যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, এতে স্যালাইন-সংকটের আশঙ্কা করছেন তিনি।