নারায়ণগঞ্জের বন্দরে শীতলক্ষ্যার তীরে প্রকল্প নিয়ে প্রশাসন–সিটি করপোরেশন মুখোমুখি
শীতলক্ষ্যার তীরে ওয়াকওয়ে এবং খেলার মাঠের প্রকল্প নিয়েছে সিটি করপোরেশন। সেখানে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার উত্তর লক্ষ্মণখোলা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে জনসাধারণের হাঁটাচলার রাস্তা (ওয়াকওয়ে), পার্ক ও খেলার মাঠ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এ লক্ষ্যে বালু ভরাট করছে তারা।
তবে ওই জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণের জন্য প্রশাসন ওই জমি মাপতে গেলে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও তাঁর লোকজন বাধা দেন।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্দর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১০৩টি ঘর বানিয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ৩৭টি ঘরের কাজ চলমান। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর লক্ষ্মণখোলা এলাকায় শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে নতুন আরও ২৫টি ঘর নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এ লক্ষ্যে গত মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে জমি মাপতে যান উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের লোকজন। এরপর সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এনায়েত হোসেন ও তাঁর লোকজন তাঁদের বাধা দেন। তখন উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
কাউন্সিলর এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য প্রশাসনের লোকজন জমি মাপতে এলে জনস্বার্থে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। তাঁরা তাঁকে গ্রেপ্তার করার ভয় দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারের খাসজমির অভাব নেই।
কীভাবে খেলার মাঠে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় প্রশাসন?
এর আগে ২১ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামকে শীতলক্ষ্যা পাড়ের জমিতে আশ্রয়ণের ঘর তৈরি না করার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, সিটি এলাকায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। রাজধানীর পাশের জেলা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ চাকরি–ব্যবসার সুবাদে নারায়ণগঞ্জে আসেন। নগরবাসীর নাগরিক সেবা নিশ্চিতে নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে উন্মুক্ত পার্ক, বিনোদনকেন্দ্র, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে সিটি করপোরেশন।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনাও আছে। শিশুদের মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিশুবান্ধব সেবা, পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে পার্ক, বৃক্ষরোপণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য নির্দেশনা আছে আদালতের। নির্দেশনা অনুযায়ী জরিপ শেষে নদীর তীরে সীমানা পিলার স্থাপন করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ ওয়াকওয়ে ও পেভমেন্ট নির্মাণ করবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ওই নির্দেশনার আলোকে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মণখোলা মৌজায় শীতলক্ষ্যা পাড়ে ওয়াকওয়ে, বৃক্ষরোপণ, পার্ক ও খেলার মাঠ নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেখানে বালু ভরাটের কাজ চলছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন ওই জমিতে ভূমি-গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে নগরের ওপর বাড়তি চাপসহ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন মেয়র। এ ছাড়া ইউনিয়নভুক্ত এলাকায় কৃষি খাসজমি থাকা সত্ত্বেও নগরের ভেতরে নদীর তীরে ঘর নির্মাণের পদক্ষেপকে অনভিপ্রেত উল্লেখ করেছেন তিনি।
এর আগে গত বছরের ১২ এপ্রিল জেলা প্রশাসককে লক্ষ্মণখোলা মৌজায় আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করতে চিঠি দিয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল আমিন। এরপরও সেখানে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কুদরত-এ খুদা প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের নতুন ২৫টি ঘর বানাতে ৫০ শতাংশ জমির প্রয়োজন। উত্তর লক্ষ্মণখোলা মৌজায় তাঁদের নিজস্ব খাসজমিতে ঘর নির্মাণের লক্ষ্যে মঙ্গলবার জমি মাপতে গেলে স্থানীয় কাউন্সিলর বাধা দেন। তিনি বলেন, আশ্রয়ণের ঘর নিজস্ব খাসজমিতে করতে হয়। জমিটি জেলা প্রশাসনের নিজস্ব খাসজমি। অন্য কোথাও খাসজমি পাওয়া গেলে সেখানে ঘর বানানো হবে। অন্যথায় শীতলক্ষ্যার পাড়েই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের যেমন খেলার মাঠের প্রয়োজন আছে, তেমনি ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ করাও দরকার। এই ঘর করতে হলে খাসজমিতে করতে হবে। খেলার মাঠের পাশে খাসজমিতে সমন্বয় করে ঘর তৈরি করা যায় কি না সেটি আমরা দেখছি।’ সিটি করপোরেশনের ইউনিয়নভুক্ত কোনো খাসজমিতে ঘর তৈরির প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা তো ইউনিয়ন পরিষদে যাবেন না। তাঁকে সিটির ভেতরে ঘর তৈরি করে দিতে হবে। বিষয়টি সমন্বয় করে করা হবে বলে তিনি জানান।
মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, নগরে খেলার মাঠের সংকট। বাচ্চাদের খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তৈরি করতে হবে কেন? নদীর তীরে জনবসতি স্থাপনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ উচ্চ আদালতের রায়সহ অন্যান্য নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। তাই ইউনিয়নভুক্ত সরকারি খাসজমিতে প্রকল্পের ঘর নির্মাণের আহ্বান জানান তিনি।
প্রশাসনের এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশন আন্দোলন জেলা কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক। তিনি বলেন, জনস্বার্থবিরোধী উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে প্রশাসনের। নদীর তীরের জমিতে আশ্রয়ণের ঘর বানানো যাবে না।