পানি দিয়ে ইটিপি পরীক্ষা পঞ্চগড় চিনিকলে

আড়াই বছর আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মরিচা পড়তে শুরু করেছে মূল কারখানার মূল্যবান যন্ত্রপাতিতে।

পঞ্চগড় চিনিকলে ৬ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ইটিপি নির্মাণ করা হয়েছে। তবে আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এটি অব্যবহৃত পড়ে আছে। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

চারদিক সুনসান। কারখানার মূল ফটকের চেকপোস্টে বসে আছেন একজন নিরাপত্তাকর্মী। মাঠে পড়ে আছে আখ পরিবহনের ট্রাক্টর-ট্রলিসহ নানা যন্ত্রাংশ। বেশির ভাগ জায়গা ভরে গেছে ঝোপঝাড় ও লতাপাতায়। মরিচা পড়তে শুরু করেছে মূল কারখানার মূল্যবান অনেক যন্ত্রপাতিতে। কিছুটা পূর্ব দিকে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি)। তবে চালু না থাকায় ইটিপির চারদিক ভরে গেছে ঝোপঝাড়ে। সম্প্রতি পঞ্চগড় চিনিকলে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।

এই চিনিকলে আড়াই বছর ধরে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে ৬ কোটি ৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ইটিপি নির্মাণ করা হয়েছে। গত বছরের ৩১ মার্চ ইটিপি নির্মাণকাজ শেষ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়ে চলতি বছরের মে মাসে ইটিপি ট্রায়াল (পরীক্ষা) করা হয়। এ সময় বর্জ্য না থাকায় সাদা পানি ব্যবহার করা হয়েছিল।

চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা বলছেন, সক্ষমতা থাকার পরও চিনিকলে আখমাড়াই শুরু করা হচ্ছে না। উল্টো ইটিপি নির্মাণ করে সরকারের টাকা অপচয় করা হয়েছে। এটি ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে যাবে। আবার ইটিপি নির্মাণ দেখে অনেকে আশায় বুক বাঁধছেন, হয়তো আবার আখমাড়াই শুরু হবে।

পঞ্চগড় চিনিকলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সভাপতি নাইবুল হক বলেন, চিনিকল লোকসানের কারণ সরকার; এখানে শ্রমিক-কর্মচারীর কোনো দোষ নেই। ইটিপি নির্মাণ ভালোই ছিল। চিনিকলের বর্জ্যে যেন পরিবেশ বা পানিদূষণ না হয়, এ জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হলো চিনিকলটিকে চালু করা।

ষাটের দশকে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের ধাক্কামারা এলাকায় ২১ দশমিক ২৮ একর জমির ওপর স্থাপন করা হয় চিনিকল। এই চিনিকলের মোট জমির পরিমাণ ২২৩ দশমিক ৩৮ একর। এর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১০০ একর। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরের পর থেকে ব্যয় বেড়ে যাওয়া, আখের উৎপাদন কমে যাওয়াসহ নানা কারণে লোকসান গুনতে শুরু করে কারখানাটি। ২০২০ সালে এসে লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩০ কোটি টাকায়। ওই বছরের ডিসেম্বরে দেশের ছয়টি কারখানার সঙ্গে পঞ্চগড় চিনিকলেরও মাড়াই কার্যক্রম স্থগিত করে সরকার।

চিনিকল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ইটিপি নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ জুলাই। গত বছরের (২০২২) ৩১ মার্চ পঞ্চগড় চিনিকলে ইটিপি নির্মাণ কাজ শেষ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবিএম ওয়াটার কোম্পানি লিমিটেড।

২০২০ সালে পঞ্চগড় চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণার সময় জেলা মোট ৩ হাজার ৫০০ একর জমিতে আখ ছিল। পরে এসব আখ ঠাকুরগাঁও চিনিকলে সরবরাহ করা হয়। এর পর থেকে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের আওতায় পঞ্চগড়ে আখ চাষ হলেও চাষের পরিমাণ কমে এসেছে। জেলায় এবার আখ চাষ হয়েছে ৫৩২ একর জমিতে। বন্ধ ঘোষণার সময় চিনিকলে স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মকর্তা–কর্মচারী ছিলেন ৩৩২ জন। বর্তমানে আছেন ৯৭ জন।

এদিকে মাড়াই বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অস্থায়ী (কানামুনা) শ্রমিক কর্মচারীদের বাদ দিয়ে স্থায়ী কিছু কর্মকর্তা–কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি করা হয়ে। সেই সঙ্গে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদের বিপরীতে ইনচার্জ পদায়ন করা হয়। আখ পরিবহনের জন্য সচল ট্রাক্টর-ট্রলিগুলো অন্য চিনিকলে স্থানান্তর করা হয়েছে।

পঞ্চগড় চিনিকলে আখমাড়াইয়ের সক্ষমতা দৈনিক ১ হাজার ১৬ মেট্রিক টন। বর্তমানে চিনিকলটিতে কোনো চিনি মজুত না থাকলেও ৪৮৯ মেট্রিক টন চিটাগুড় অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। সময়মতো বিক্রি করতে না পারায় এসব চিটাগুড়ের গুণগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চিনিকলটির পঞ্চগড় সোনালী ব্যাংক শাখায় ঋণের পরিমাণ ২৪৩ কোটি টাকা। তা ছাড়া এই চিনিকলের নামে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের করা ২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণ আছে। যা থেকে প্রতিবছর ১৮-২০ কোটি টাকা সুদ বাড়ছে। এ ছাড়া চিনিকলের ২৬০ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীর ৯ কোটি ২৪ লাখ গ্রাচ্যুইটির টাকা বকেয়া আছে।

পঞ্চগড় চিনিকলের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চিনিকল বন্ধ নয়, মাড়াই স্থগিত করা হয়েছে। কারখানাগুলোকে আধুনিকায়ন করতে সরকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে চিনিকলে ইটিপি নির্মাণকাজ শুরু হয়। যদি চিনিকল চালু হয়, তাহলে বর্জ্য নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তা আর হবে না।