বৃন্দাবনী: যে আমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বনেদিআনা
ছোট গড়নের আম। একটু গোলগাল ধরনের। যেখানে রাখা হয়, মুহূর্তেই সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাকলে খোসাটা গাঢ় হলুদাভ হয়। কাটার পর শাঁসের রংটাও মন জুড়ায়। স্বাদে টক-মিষ্টির এক সুন্দর সংমিশ্রণ। রূপে-গন্ধে-স্বাদে অন্য আমের তুলনায় একেবারেই আলাদা। নাম বৃন্দাবনী আম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরশাপাতের পাশে বহু বছর ধরেই এক নীরব মর্যাদা নিয়ে আছে বৃন্দাবনী আম। তবে এ আম সহজে চোখে পড়ে না। কারণ, সবাই এই আম সম্পর্কে জানেন না। যাঁরা জানেন, বোঝেন; তাঁরা ঠিকই জোগাড় করেন। নিজেরা খান, স্বজন-বন্ধুদের পাঠান।
এই আম সম্পর্কে চমৎকার সব তথ্য দিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আইনজীবী আনন্দ শংকর রায় চৌধুরী। আইনজীবী হয়েও বৃন্দাবনী আম নিয়ে এত জানা-বোঝার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর পারিবারিক ইতিহাস। আনন্দের বাবা রূপেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী (ভুতু উকিল নামে পরিচিত) ছিলেন আইনজীবী ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। তাঁর বন্ধুত্ব ছিল আরেক আইনজীবী সবিতা রঞ্জন পালের (এস আর পাল) সঙ্গে। তাঁরা দুজনই বৃন্দাবনী আমের ভক্ত ছিলেন। আমের মৌসুমে রূপেন্দ্র বৃন্দাবনী আম কিনে পাঠাতেন এস আর পালকে। ছোটবেলা থেকে দেখে, খেয়ে এই আমের প্রতি ভালো লাগা আনন্দ শংকরের।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় এই আমের উৎপত্তি। মালদহ ও মুর্শিদাবাদে এই আম খুবই জনপ্রিয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ একসময় মালদহ জেলার অংশ ছিল।
বাবার মৃত্যুর পর আনন্দ শংকর রায় চৌধুরী বৃন্দাবনী আম নিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এর ভিত্তিতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় এই আমের উৎপত্তি। মালদহ ও মুর্শিদাবাদে এই আম খুবই জনপ্রিয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ একসময় মালদহ জেলার অংশ ছিল। আর মালদহ প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের অংশ। কলির কৃষ্ণ হিসেবে শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলনের বেশ প্রভাব ছিল গৌড়ে। কোনো বৈষ্ণবভক্ত বৈষ্ণব আন্দোলনের সূতিকাগার বৃন্দাবনের নামানুসারে আমের নাম ‘বৃন্দাবনী’ রেখেছেন বলে জনশ্রুতি আছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেড় শ থেকে দু শ বছরের পুরোনো আমবাগানের কোনো কোনোটিতে বৃন্দাবনী আমগাছ আছে। বিশেষ করে বনেদি, শৌখিন ও ধনাঢ্য আমবাগানিদের বাগানে বহুল প্রচলিত ফজলি, ক্ষীরশাপাত ও ল্যাংড়া আমের পাশাপাশি দু-চারটি বৃন্দাবনী আমের গাছ আছে। সাধারণত নিজেদের খাওয়ার জন্য, প্রিয়জনদের উপহার দেওয়ার জন্য তাঁরা এই জাতের গাছ লাগাতেন। একসময় জমিদার, কুলীন হিন্দু ও মুসলিম পরিবারগুলোর বিশেষ পছন্দের আম ছিল বৃন্দাবনী, এমনটাই ভাষ্য আনন্দ শংকর রায় চৌধুরীর।
বৃন্দাবনী আমের গাছ আছে, এমন একটি বাগান হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ‘সেকেন্দার চৌধুরীর আমবাগান’। সম্প্রতি ওই বাগানে গেলে শওকত আলী নামের এক শ্রমিক বলেন, সব বাগানে বৃন্দাবনী জাতের আম নেই। মাত্র কয়েকটি পুরোনো আমবাগানে এটা আছে। শৌখিন মানুষেরা দু-চারটি করে লাগিয়েছিলেন। এই আমের ফলন কম। ফলে নতুন করে কেউ আর এই জাতের আমগাছ লাগান না। অথচ এ আমের স্বাদ একেবারেই আলাদা, অন্য আমের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না।
কৃষি উদ্যোক্তা মুনজের আলম বলেন, বৃন্দাবনী আমের কথা তিনি গত বছরই প্রথম শুনেছেন। এবার সেকেন্দার চৌধুরীর আমবাগান থেকে এক মণ আম কিনেছেন। নিজেরা খেয়েছেন, নিজের বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি করেছেন। এই আম সব ধরনের ক্রেতা কেনেন না। যাঁরা আমটি সম্পর্কে জানেন বা আগে থেকেই খেয়ে অভ্যস্ত, তাঁরাই কেবল নেন। এত সুস্বাদু ও ভালো জাতের আমটি টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।
যাঁরা এই আম চেনেন, তাঁরা বেশি দামে কিনে নিয়ে যান। অন্যরা এর কদর দিতে জানেন না। কেউ কেউ তো গুটি আমের মতো সাধারণ কোনো আম মনে করেন।
বৃন্দাবনীর সঙ্গে যে বনেদিপনা জড়িয়ে আছে, সেটা উঠে এল কানসাটের আমচাষি ও ব্যবসায়ী রবিউল আওয়ালের কথায়। তিনি বলেন, তাঁর নানার বাবা হায়দার বক্স ছিলেন শৌখিন আমচাষি। তিনি ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে বৃন্দাবনীর দুটি চারা এনে বাগানে লাগিয়েছিলেন। সেই গাছ দুটি কাটা পড়ে শরিকদের মধ্যে জমি ভাগাভাগি করতে গিয়ে। তবে সেই গাছ থেকে কলম করে তিনি নিজে ২০০৪ সালে লাগিয়েছেন। গাছ দুটিতে এখন আম ধরে। তাঁরা নিজেরা খান। আর যাঁরা এই আম চেনেন, তাঁরা বেশি দামে কিনে নিয়ে যান। অন্যরা এর কদর দিতে জানেন না। কেউ কেউ তো গুটি আমের মতো সাধারণ কোনো আম মনে করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের আমবাগানের বেশির ভাগ গাছ দেড় শ থেকে দুই শ বছর বয়সী। এখানে দুটি বৃন্দাবনী আমের গাছ আছে। তবে চারা তৈরি করা হয় না। কারণ হিসেবে এখানকার উপসহকারী উদ্যান কর্মকর্তা ফাইজুর রহমান বলেন, মানুষ বৃন্দাবনীর চারা চান না, তাই চারাও তৈরি করা হয় না। একই কথা জানালেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণা কেন্দ্র) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, সবাই এখন বিদেশি নাবি জাতের বা বারোমাসি জাতের আমের দিকে ঝুঁকছেন।
জাতটি সংরক্ষণ হওয়া দরকার বলে মনে করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক মো. মঞ্জুরে মাওলা। তিনি বলেন, অত্যন্ত সুঘ্রাণযুক্ত এ আমের ঘ্রাণেই বোঝা যায় এর রাজকীয় ভাব। এই জাতের আমে দ্রবীভূত শর্করার পরিমাণ (টিএসএস) ১৮ থেকে ২০। এর অর্থ হলো আমটি বেশ মিষ্টি। মূল জাতটি টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি সংকরায়ণের মাধ্যমে আরও উন্নত জাতের আম পাওয়া সম্ভব।