প্রকল্পের টাকা খরচে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে ইউজিসি, তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একটি বিভাগ খোলার প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও হিসাব নম্বর বন্ধ না করে চার বছর ধরে সেই হিসাব নম্বর থেকে বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে ১২ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার ৪১৩ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

গত বছরের জুনে প্রকল্পের টাকা খরচের অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত করে ইউজিসি। এরপর সেই প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয় কমিটি। সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি পেয়েছে প্রথম আলো। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে একই দিনে কার্যাদেশ ও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করার ঘটনাও ঘটেছে এ প্রকল্পে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ‘পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ চালুকরণের লক্ষ্যে অবকাঠামোগত ও ল্যাবরেটরি সুবিধাদি সৃষ্টিকরণ’ প্রকল্পের আওতায় রুয়েটে গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট বরাদ্দ ছিল ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আলীম। তাঁর বিরুদ্ধেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে অজ্ঞাতনামা একটি সূত্র দুদকে লিখিত অভিযোগ করে। দুদক বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য ইউজিসিকে দায়িত্ব দেয়। এরপর গত জুনে ইউজিসি বিষয়টি তদন্ত করে। এ নিয়ে গত ৭ জুন প্রথম আলোতে ‘নিজের মতো করে খরচ হয়েছে বেঁচে যাওয়া টাকা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

২০০৯ সালের ১ জুলাই ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরে তা বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন করা হয়।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বড় কথা হলো প্রকল্প শেষ হওয়ার পর ওই প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব নম্বর আর রাখা যাবে না। উদ্বৃত্ত শূন্য দেখিয়ে প্রকল্প পরিচালক চিঠি দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ব্যাংকে তখনো টাকা রয়ে গেছে। তাঁরা তদন্তে এসেও সেই হিসাব নম্বরের অস্তিত্ব পেয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ কাজের জন্য টাকা ধার করা হয়েছিল। উদ্বৃত্ত থেকে সেই ধার শোধ করা হয়নি। এ ছাড়া একই দিনে কার্যাদেশ ও বিল পরিশোধের বিষয়টি তো আছেই। তিনি বলেন, তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আবদুল আলীম বলেছেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষের দিনেই ইউজিসি টাকা পাঠিয়েছে। তখন প্রকল্পটি শেষ করার প্রয়োজনেই একই দিনে সবকিছু দেখাতে হয়েছে। বাস্তবে কাজ পরে হয়েছে। বিলও পরে দেওয়া হয়েছে। এখানে তিনি স্বচ্ছতার সঙ্গে সবকিছু করেছেন। কিছু ঠিকাদার কাজ শেষ করেও বিল প্রদান করেননি। এ কারণে এখনো ব্যাংকে কিছু টাকা আছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ১ জুলাই ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরে তা বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন করা হয়। ২০১৬ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ৯ আগস্ট আবদুল আলীম প্রকল্প শেষ হয়েছে বলে ইউজিসিতে প্রতিবেদন পাঠান। এতে তিনি প্রকল্পের বরাদ্দের ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকার সবই ব্যয় হয়েছে বলে জানান।

নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য ব্যাংকে একটি হিসাব নম্বর খুলতে হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাংক হিসাব নম্বর বন্ধ করে দিতে হয়। ওই হিসাব নম্বরে কোনো টাকা থাকলে তখনই সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। এ প্রকল্প পরিচালক তা করেননি।

তদন্ত প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের মেয়াদ শেষেও ওই হিসাব নম্বরে ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৭ হাজার ২৭২ টাকা জমা ছিল। পরে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চার বছরে বিভিন্ন কাজের বিল দেখিয়ে ১২ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার ৪১৩ টাকা তোলা হয়। ২০২০ সালের ৩০ জুন সর্বশেষ টাকা তোলার পর ৫০ লাখ ৩৬ হাজার ৮৫৯ টাকা ব্যাংকে আছে। এদিকে সরকারি বিধি অনুযায়ী যেকোনো কাজের বিল প্রদানের সময় ক্ষেত্রবিশেষে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ কেটে নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে তা ভ্যাট ও ট্যাক্স অফিসে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩০ জুন থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত উত্তোলন করা ওই বিলের ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ আনুমানিক দেড় কোটি টাকা জমা দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। ভ্যাট-ট্যাক্সের বড় অঙ্কের এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তদন্তে আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে, বিভাগের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ২০১৬ সালের ৩০ জুন ই-টেন্ডারের মাধ্যমে ‘ইনটেক লজিস্টিক লিমিটেড’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওই কার্যাদেশে ওই বছরের ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি জমা দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করতে বলা হয়। কাজটির চুক্তিমূল্য ছিল ৬৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা।

নথিপত্রের হিসাব অনুযায়ী, ইনটেক লজিস্টিক লিমিটেড ২০১৬ সালের ৩০ জুন ‘নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড’ পায়। ওই দিনই ৬ লাখ ৭৮ হাজার ২০০ টাকা পারফরম্যান্স সিকিউরিটি জমা দিয়ে চুক্তি সম্পন্ন করে। একই দিনে ঠিকাদার দরপত্রের সব যন্ত্রপাতি রুয়েটের কেন্দ্রীয় ভান্ডারে সরবরাহ করেন। একই তারিখে কাজটির বিল প্রস্তুত ও অডিট সম্পন্ন করে চেক প্রদানও করেন প্রকল্প পরিচালক।