নবাবগঞ্জে ৩০০ বছরের পুরোনো বর্দ্ধনপাড়া দুর্গামন্দিরে দেশি-বিদেশি ভক্তদের ভিড়

ঢাকার নবাবগঞ্জের বর্দ্ধনপাড়া বড়বাড়ি পালপাড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে ভক্তদের ভিড়। রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার পাশেই ইছামতী নদীর কোল ঘেঁষে নবাবগঞ্জ উপজেলার বর্দ্ধনপাড়া গ্রাম। ইতিহাসসমৃদ্ধ এ গ্রাম একসময় মৃৎশিল্পের ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থস্থান ছিল। এ গ্রামে ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্দ্ধনপাড়া বড়বাড়ি পালপাড়া সর্বজনীন দুর্গামন্দির। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমী থেকে এ মন্দিরে দেশি-বিদেশি ভক্তদের ঢল নামে।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে এ অঞ্চলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রায় তিন শ বছর আগে এখানে তাঁদের বসতি গড়ে ওঠে। তাঁদের মূল পেশা ছিল মৃৎশিল্প। তাই এ গ্রামের নামকরণ হয় বর্দ্ধনপাড়া পালপাড়া গ্রাম। গয়না নৌকাযোগে পালদের তৈরি করা মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হতো। তখন ইছামতী নদীর বর্দ্ধনপাড়া ঘাটে ভিড়ত সারি সারি নৌকা। সেই সময়ে স্থানীয় শরৎ সাধু কুন্ডু ও গোবিন্দ পাল পূর্জা অর্চনা করতে পালপাড়া বড়বাড়িতে নির্মাণ করেন একটি মন্দির। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ও স্মৃতি ধরে রাখতেই পরবর্তী প্রজম্ম এ মন্দিরটিকে পালপাড়া বড়বাড়ি সর্বজনীন দুর্গামন্দির হিসেবে গড়ে তোলে।

মন্দিরের ইতিহাস জানিয়ে বর্দ্ধনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ৯১ বছর বয়সী কানাই পাল বলেন, এ দুর্গামন্দিরের বয়স প্রায় ৩০৭ বছর। বাংলা ১১২৫ সালে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এটা নির্মাণ করেন। ওই সময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দল বেঁধে এ মন্দিরে পূজা করতে আসতেন। ঐতিহাসিক এ মন্দিরে প্রতিবছর হাজার হাজার পূজারি এসে পূজা অর্চনা করে থাকেন।

গতকাল রোববার মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ৯টায় মহাঅষ্টমীর প্রথম প্রহরে শত শত নারী-পুরুষ মন্দির চত্বরে ভিড় জমিয়েছেন। তাঁরা দেবী দুর্গার আশীর্বাদ পেতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করছেন। এঁদের মধ্যে বিদেশি ভক্তরাও রয়েছেন।

ঢাকার নবাবগঞ্জের বর্দ্ধনপাড়া বড়বাড়ি পালপাড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে ভক্তদের ভিড়। রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

পুরান ঢাকার নারিন্দা থেকে আসা রুমা পাল (৩৮) বলেন, দুর্গাপূজায় এ মন্দিরে না এলে যেন মায়ের আশীর্বাদের পরিপূর্ণতা হয় না। তাই প্রতিবছর পরিবার নিয়ে তিনি এখানে এসে মহাঅষ্টমীতে মাকে অঞ্জলি প্রদান করেন। ভারতের কলকাতা থেকে বর্দ্ধনপাড়ার মন্দিরটিতে পূজা দিতে এসেছেন মণি পাল (৩৫)। তিনি বলেন, ‘দুর্গা মাকে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। সব পাপাচার থেকে মুক্তির আশায় মায়ের আশীর্বাদ পেতে এ মন্দিরে এসেছি। নবাবগঞ্জে আমাদের স্বজনদের বাসায় অবস্থান করছি। পূজা শেষে কলকাতায় ফিরে যাব। বড়দা ও ঠাকুমাসহ সবাই মিলে এ পূজায় অংশ নিয়েছি।’

বর্দ্ধনপাড়া বড়বাড়ি পালপাড়া সর্বজনীন দুর্গামন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, জাঁকজমক পরিবেশে প্রাচীন এ মন্দিরে ভক্তরা পূজা উদ্‌যাপন করছেন। তবে ঐতিহ্যবাহী মন্দির হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বাড়তি কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। যুগের পর যুগ নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই পূজার আয়োজন করা হচ্ছে।

বর্দ্ধনপাড়া পালপাড়া বড়বাড়ি দুর্গামন্দিরকে ইতিহাস ও ঐহিত্যের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করলেন পালপাড়া কল্যাণ সমিতির সভাপতি রতি রঞ্জন পাল। তিনি বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় প্রায় ১৯৪টি দুর্গাপূজার মণ্ডপ থাকলেও এ মন্দিরকে ঘিরে পূজারি ও ভক্তদের মাঝে বিশেষ আমেজ কাজ করে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোলকতা থেকেও ভক্তরা এখানে পূজা করতে আসেন।’

নবাবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম শেখ বলেন, মণ্ডপগুলোর নিরাপত্তায় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলার ১৯৪টি পূজামণ্ডপ সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আছে। এ ছাড়া র‍্যাব, পুলিশ, আনসার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।