খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি প্রার্থী দিতে নাগরিক সমাজের উদ্যোগ, বাড়ছে কৌতূহল

পর্যটনকেন্দ্র আলুটিলা থেকে খাগড়াছড়ি শহরছবি: প্রথম আলো

জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে জেলার নাগরিক সমাজ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিশিষ্টজনদের উদ্যোগে ‘গ্রহণযোগ্য’ ও ‘দক্ষ’ একজন প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে খাগড়াছড়ির রাজনীতিতে নতুন আলোচনা তৈরি হয়েছে।

নাগরিক সমাজের ব্যানারে প্রার্থী দেওয়ার এই উদ্যোগ বড় দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীদের আলোচনাকে অনেকটাই ছাপিয়ে গেছে। কারণ, শেষ পর্যন্ত প্রার্থী চূড়ান্ত হলে তাঁকে পাহাড়ে সক্রিয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন দিতে পারে—এমন আলোচনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী লড়াইয়ে এই প্রার্থী একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন।

প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বোধিসত্ত্ব দেওয়ানকে।

নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৯ ডিসেম্বর। নির্বাচনী প্রচার ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত।

কেন নাগরিক সমাজের এই উদ্যোগ

খাগড়াছড়ির নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় দলগুলোর পাশাপাশি আঞ্চলিক দলের বড় ভূমিকা রয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকায় আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেন, বাস্তবে প্রচার চলে দলীয় ব্যানারেই।

এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর খাগড়াছড়িতে দুটি বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটে, এতে সাতজন নিহত হন। এ ছাড়া দুই পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ঘিরে জেলায় তীব্র আন্দোলন হয়। এসব ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বাঙালি হওয়ায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এ ছাড়া পাহাড়ে সক্রিয় আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তিও প্রকট। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য দুটি আসনে জাতীয় দলগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকে প্রার্থী দিলেও খাগড়াছড়ি আসনে তা হয়নি। পাহাড়িদের দীর্ঘদিনের ভূমি, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানে জাতীয় দলগুলো আন্তরিক নয়—এমন অভিযোগও রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার ভাবনা সামনে এসেছে।

প্রার্থী বাছাইপ্রক্রিয়া

কমিটি ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সেখানে অন্তত ছয়জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম আলোচনায় এসেছে। সাবেক জনপ্রতিনিধি ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের নাম উঠে এলেও এখনো কারও নাম প্রকাশ করা হয়নি। প্রার্থী চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

কমিটির প্রধান বোধিসত্ত্ব দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাগড়াছড়ির নাগরিক সমাজ মনে করছে, এই আসনে এমন একজন প্রার্থী দরকার, যিনি সর্বজনগ্রাহ্য, দক্ষ এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো বোঝেন। সে লক্ষ্যেই আলোচনা চলছে।’

জাতীয় ও আঞ্চলিক দলের বাইরে গিয়ে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে বোধিসত্ত্ব দেওয়ান বলেন, ‘আঞ্চলিক দলগুলো এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। আর জাতীয় দলগুলোর রাজনীতি আমরা বহুদিন ধরেই দেখছি। নতুন করে ভাবার প্রয়োজন থেকেই এ উদ্যোগ।’

আরও পড়ুন

দলগুলোর অবস্থান

খাগড়াছড়ি আসনে ইতিমধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে তিন দলের ঘোষিত প্রার্থীই বাঙালি।

খাগড়াছড়ি আসনে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. এয়াকুব আলী চৌধুরী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রার্থী কেন্দ্রীয় সংগঠক মনজিলা সুলতানা। আঞ্চলিক দলগুলো এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। শেষ পর্যন্ত নাগরিক সমাজ প্রার্থী দিলে তারা তাঁকেই সমর্থন দিতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) মুখপাত্র জুপিটার চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, নাগরিক সমাজ যদি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকে একজন গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেয়, যিনি পাহাড়িদের অধিকার এবং পাহাড়ি-বাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে কাজ করবেন, তাহলে তাঁকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে।

আরও পড়ুন

খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ইউপিডিএফ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধের জের ধরে ১৯৯৮ সালে এই দলের প্রতিষ্ঠা। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ ২০০১, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিলেও প্রতিবারই মূল লড়াইয়ে ছিল দলটি।

ইউপিডিএফের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খাগড়াছড়িতে এখনো পুরোপুরি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। তবে নাগরিক সমাজের প্রার্থী যদি গ্রহণযোগ্য হন, তাহলে সমর্থনের বিষয়ে দল সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতারাও নাগরিক সমাজের প্রার্থী দেওয়ার আলোচনা সম্পর্কে অবগত থাকার কথা জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে খাগড়াছড়িতে এবার নির্বাচনী লড়াই ভিন্ন মাত্রা পেতে পারে।

ভোটের হিসাব

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চারটি নির্বাচনে খাগড়াছড়িতে তিনবার আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) এবং ২০০১–এ বিএনপির প্রার্থী জিতেছিলেন। এর মধ্যে ১৯৯১ ও ১৯৯৬–এ কল্পরঞ্জন চাকমা এবং ২০০৮–এ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা জিতেছিলেন। আর ২০০১–এ জয়লাভ করেছিলেন বিএনপির প্রার্থী আবদুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আসনের মধ্যে খাগড়াছড়িতে ভোটার সবচেয়ে বেশি—৫ লাখ ৫৪ হাজার ১১৯ জন। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, জেলায় বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় সমান। এ বাস্তবতায় নাগরিক সমাজের প্রার্থী চূড়ান্ত হলে ভোটের সমীকরণে তা বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।