‘বউ-ছল লিয়ে মরা ছাড়া বুদ্ধি থ্যাকবে না’

জমিতে ধানের চারা রোপণ করছেন বর্গাচাষি বেলাল হোসেন। মঙ্গলবার নওগাঁ সদর উপজেলার জগৎ সিংহপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো


বরেন্দ্র ভূমি হিসেবে পরিচিত নওগাঁ জেলায় একসময় বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল হতো না। তবে কৃষির আধুনিকায়নের ফলে জেলার অধিকাংশ জমিতেই এখন তিন ফসল চাষাবাদ হয়। এর মধ্যে ধান চাষে আগ্রহ বেশি কৃষকের। এ এলাকায় বেশি ধান উৎপাদন হওয়ায় স্থানীয়রা নওগাঁকে ‘ধানের রাজধানী’ বলে থাকেন।

চলতি আমন মৌসুমে নওগাঁয় দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৯৭ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা এ জেলার কৃষকদের কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কারণ, রোপা আমনের ভরা মৌসুমে কয়েক দিনের ব্যবধানে ইউরিয়া ও ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকেরা।

কৃষকেরা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বেশি সমস্যায় বর্গাচাষি ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা। তাঁদের ভাষ্য, সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রতি বিঘায় ধান উৎপাদনে বাড়তি ৩ হাজার টাকা খরচ পড়বে। প্রতি বিঘা জমিতে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে ফসল উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য না পেলে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হবে তাঁদের।

নওগাঁ সদর উপজেলার জগৎ সিংহপুর মাঠে বর্গা নেওয়া জমিতে ছেলে সামিউলকে নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে ধানের চারা রোপণ করছিলেন নওগাঁ পৌরসভার বোয়ালিয়া এলাকার বাসিন্দা বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘চাষাবাদ করে অ্যাখন ব্যাঁচে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে আগে এক বিঘা জমিত একবার হাল (চাষ) দিতে পাওয়ার টিলার মালিকেরা ২৫০ টাকা লিত, অ্যাখন সেটিত ল্যাওচে ৪০০ টাকা। গত বোরো মৌসুমে এই জমিত শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিতে ১২০ টাকা দিতে হতো, অ্যাখন দিতে হচ্ছে ২০০ টাকা। আবার ইউরিয়া সারের দাম প্রতি ধাড়ায় (৫ কেজি) বাড়ছে ৩০ টাকা করে। অ্যাত খরচ করে ধানের ন্যায্য দাম না পাইলে বউ-ছল লিয়ে মরা ছাড়া বুদ্ধি থ্যাকবে না।’

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইউরিয়া সারের দাম প্রতি কেজিতে ৬ টাকা করে বৃদ্ধি করায় প্রতি বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি খরচ পড়বে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে ধান উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে একলাফে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ধানের জমি প্রস্তুতের জন্য পাওয়ার টিলার কিংবা ট্রাক্টর দিয়ে তিন চাষে আগে ৭৫০ টাকা নেওয়া হতো, এখন সেখানে নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা।

অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর সেচ দিয়ে ধান আবাদ করতেও বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে আগে যেখানে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা নেওয়া হতো, এখন সেখানে নেওয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। শ্যালো ইঞ্জিন থেকে জমির দূরত্বের অনুপাতে এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগে থাকে। সে হিসাবে এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে বাড়তি প্রায় ২০০ টাকা খরচ পড়ছে। একটি জমিতে পুরো মৌসুমে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়লে সাধারণত ১০ থেকে ১২ বার সেচ দিতে হয়। অর্থাৎ প্রতি বিঘা জমিতে সেচ খরচ বাড়বে প্রায় ২ হাজার টাকা। ইউরিয়া ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ধান উৎপাদনে প্রায় ৩ হাজার টাকা বেশি খরচ পড়বে।

আগে তাঁর এক বিঘা জমিতে আমন উৎপাদনে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ পড়ত। সার ও ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে এবার প্রতি বিঘায় ধান উৎপাদনে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ পড়বে।
সাইফুল ইসলাম, কৃষক
জমিতে ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর কৃষকেরা। সম্প্রতি নওগাঁর পোরশা উপজেলার সারাইগাছী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁ সদর উপজেলার হুড়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম এ বছর ১২ বিঘা জমিতে আমন আবাদের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তিনি বলেন, আগে তাঁর এক বিঘা জমিতে আমন উৎপাদনে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ পড়ত। সার ও ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে এবার প্রতি বিঘায় ধান উৎপাদনে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ পড়বে।

জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) নওগাঁ জেলা শাখা সূত্রে জানা যায়, চলতি আমন মৌসুমে জেলায় আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ১১০ হেক্টর, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। জেলায় প্রায় ৬৬ হাজার পরিবার কৃষি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নওগাঁ জেলায় বিসিআইসি ও বিএডিসি অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছেন ৩৩৩ জন। চলতি আগস্ট মাসে জেলায় ইউরিয়া সারের বরাদ্দ ৯ হাজার ২৯৩ মেট্রিক টন, টিএসপি ৮৯৭ টন, ডিএপি ২ হাজার ৫৪৩ টন ও এমওপি সারের বরাদ্দ ১ হাজার ৭৯৬ টন।

কেজিপ্রতি ৬ টাকা মূল্যবৃদ্ধির ফলে কেবল ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলেই ১৫০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। এ ছাড়া ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে বাড়তি চাষ ও সেচ খরচ যোগ হবে।

বিএফএ নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতি রেজাউল ইসলাম বলেন, আমন মৌসুমে সাধারণত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারের মূল চাহিদা থাকে। ডিলারদের জন্য প্রতি মাসে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। জেলায় প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়ে থাকে। সেই অনুপাতে প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের বরাদ্দ থাকে। কেজিপ্রতি ৬ টাকা মূল্যবৃদ্ধির ফলে কেবল ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলেই ১৫০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। এ ছাড়া ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে বাড়তি চাষ ও সেচ খরচ যোগ হবে। সব মিলিয়ে ইউরিয়া ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষি উৎপাদনে একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।