মারমা সমাজের হারিয়ে যেতে বসা গীতিনাট্য ‘পাংখুং’ ও ‘জ্যাত’ যেভাবে ফিরছে মঞ্চে

মারমা সমাজে প্রচলিত ‘পাংখুং’ এর অর্থ গীতিনাট্য। ‘মহা জানাখা’ নামের ‘পাংখুং’ পালাটি গত শনিবার মঞ্চস্থ হয় ববান্দরবানের রেনীংপাড়ায়।
প্রথম আলো

বৈশালী রাজ্যের দুই রাজপুত্রের মধ্যে সিংহাসনের লড়াই চলছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ছোট ভাই পলখা জানাখার হাতে বড় ভাই আরিখা জানাখার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। জনপ্রিয় রাজপুত্রের মৃত্যুতে রাজ্যজুড়ে নেমে আসে ভয় ও শোকের ছায়া। শূন্য হাতে রাজবধূকে দেশান্তরে পাঠানো হয় চম্বকনগরে।

এমন কাহিনি নিয়ে ‘মাহা জানাখা’ নামের এই ‘পাংখুং’ বা গীতিনাট্য গত শনিবার বান্দরবান সদর উপজেলার রেনীংপাড়ায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের (কেএসআই) নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়।  মারমাদের ঐতিহ্যবাহী গীতিনাট্য ‘পাংখুং’–এর এমন মঞ্চায়ন সচারচর বান্দরবান বা ঢাকা-চট্টগ্রামের মঞ্চগুলোতে দেখা যায় না। সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এই নাট্যধারা। তবে গ্রামীণ এই নাট্যধারা টিকিয়ে রাখতে সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট।

‘পাংখুং’ গীতিনাট্য অনেকটা বাংলার যাত্রাপালা ও গীতিনাট্যের মতো। তবে এর শিল্পী, পোশাকসজ্জা, সুর, বাদ্যযন্ত্র ও কাহিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘মাহা জানাখা’ নামে ‘পাংখুং’ বৌদ্ধ জাতকের অবলম্বনে রচিত। রাজপুণ্যাহের মেলা, ধর্মীয় উৎসব ও অভিজাতদের জন্ম-মৃত্যু দিবসে রাতব্যাপী চলে ‘পাংখুং’ গীতিনাট্যের প্রদর্শনী। শীত উপেক্ষা করে রাত জেগে শিল্পীদের দরাজ গলার অভিনয় ও গানে মজে থাকেন দর্শক-শ্রোতারা। মঞ্চের বিয়োগান্ত দৃশ্যে কারও চোখের জল ঝরে, মিলনান্তক দৃশ্য জাগায় শিহরণ।

মারমা ভাষার লেখক ও গবেষক মংক্যশোয়েনু নেভী প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা হয় রাঙামাটির বেতবুনিয়ার মারমা পাড়ায় ‘পাংখুং’ পালা এক সময় বহুল প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে এ নাট্যধারা অন্যান্য মারমা প্রধান স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ার জুমচাষি মরামা নারী-পুরুষ নিজেরাই এসব পালায় অভিনয় করেন এবং পাড়াবাসীরাই দর্শক-শ্রোতা হিসেবে তা উপভোগ করেন। যুগ যুগ ধরে এটি মারমা সমাজের প্রধান বিনোদন মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ২৫-৩০ বছর আগেও বড় বড় মারমা পাড়াগুলোতে ‘পাংখুং’ দল দেখা যেত। কালের গ্রাসে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। এখন দুই-একটি দল খুঁজে পাওয়া গেলেও চাহিদা না থাকায় তাদের তেমন কোনো কাজ নেই।

অনেকের মতে, গীতিনাট্য ও যাত্রাপালার প্রভাব রয়েছে ‘পাংখুং’ এ। মারমাদের আরেক ধরনের নৃত্যনাট্য রয়েছে যার নাম ‘জ্যাত’। এতে বাংলা বা উপমহাদেশীয় ভাবধারার চেয়ে বর্মি ভাবধারার প্রভাব বেশি। কেএসআইয়ের পরিচালক মং নু চিং মারমা বলেন, ‘পাংখুং’ এ মুর্শিদাবাদের নাট্যধারা অর্থাৎ যাত্রাপালার প্রভাব রয়েছে। আর ‘জ্যাত’ বর্মি সংস্কৃতি থেকে এসেছে। এই দুই ধারার শিল্পমাধ্যমই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। কেএসআইয়ের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে লোকজ মাধ্যম দুটিকে টিকিয়ে রাখার।  

মারমা সমাজে প্রচলিত ‘পাংখুং’ এর অর্থ গীতিনাট্য। ‘মহা জানাখা’ নামের ‘পাংখুং’ পালাটি গত শনিবার মঞ্চস্থ হয় ববান্দরবানের রেনীংপাড়ায়।
প্রথম আলো

প্রাচীন লোকসাহিত্যের নানা কাহিনিকে উপজীব্য করে ‘পাংখুং’ লেখা হয়। রেনীংপাড়ার ‘পাংখুং’ দলের প্রধান ও ‘মাহা জানাখা’ নাটকের লেখক পাইসা খ্যয় মারমা বলেন, বৌদ্ধ জাতক, লোককাহিনি ও গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনিকে ভিত্তি করে গীতের সুরে নাট্যরূপ দিয়ে ‘পাংখুং’ লেখা হয়। রামায়ণ ও মহাভারতের রাম, সীতা, রাবণের কাহিনিও পাওয়া যায় এতে। ‘পাংখুং’ দলে বাদকসহ ৪১ বা ৫১ জন কলাকুশলীর প্রয়োজন হয়। সঙ্গে ক্লারিওনেট, হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা, বাঁশিসহ অনেক বাদ্যযন্ত্র থাকে।

‘মাহা জানাখা’ পালার রাজবধূর দেশান্তর হওয়ার মতোই যেন সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মারমাদের শিল্প ‘পাংখুং’ ও ‘জ্যাত’। দুর্গম পাড়া গ্রামে যেখানে এখনো আধুনিক জীবনের মিথস্ক্রিয়া অপেক্ষাকৃত কম, সেখানে কিছু দল তাদের জীর্ণ অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে মাত্র। এসব দলকেই পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কাজ করছে কেএসআই। এই পর্যন্ত রেনীংপাড়াসহ পাঁচটি ‘পাংখুং’ দল ও তিনটি ‘জ্যা’ত দলকে প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, পোশাক ও সাজসজ্জা দেওয়া হয়েছে বলে জানান পরিচালক মং নু চিং মারমা। এমন প্রচেষ্টার কারণে হারিয়ে যেতে বসা দুটি গ্রামীণ নাট্যধারা এখনো ক্ষীণ ধারায় টিকে আছে।