সুন্দরবনে কেওড়ার মৌসুমে বানরের হৃষ্টপুষ্ট চেহারা
সুন্দরবনের ভেতরে কেওড়া বনে নির্জনতা ভেঙে এখন কোলাহলে মশগুল বানরের দল। ডালে ঝুলে ঝুলে একেকটি বানর কেওড়া খেতে মহাব্যস্ত। এই নিয়ে সারা দিন চলে তাদের খুনসুটি। আনন্দের ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়—এই মৌসুম বানরদের খুব প্রিয়। এই সময় কেওড়া সহজলভ্য হওয়ায় খাবারের অভাব নেই। তাই প্রাণীগুলোকে তুলনামূলক হৃষ্টপুষ্টও লাগে।
গত সপ্তাহে জেলেদের নৌকায় বসে সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদীর তীর–সংলগ্ন কেওড়া বনে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। বানরেরা টপাটপ কেওড়া ফল ছিঁড়ে মুখে ভরছে। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে কিছু ফল হাতে-মুখে নিয়ে মুহূর্তেই গহিন জঙ্গলে লাফিয়ে চলে যায় দলটি। চারপাশে তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল কেওড়ার অর্ধেক টুকরা।
শাকবাড়িয়া নদীর ধারে মাছ ধরছিলেন জেলে রহিম গাজী। তিনি বললেন, ‘আমরাও কেওড়া ফল খাই। কেওড়া দিয়ে ডাল রান্না কইরে খাই। আবার সেদ্ধ করে বড়শিতে গেঁথে মাছ ধরি। এখন কেওড়া ফলের মৌসুম, বানরেরা সকাল-বিকেল এই ফল খেয়ে বেড়ায়। এই সময় ওদের শরীর মোটা-টাটকা লাগে, কিন্তু ফল ফুরিয়ে গেলে আবার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়।’
প্রবীণ জেলে নুরুল হক জানালেন, শ্রাবণ থেকে আশ্বিন মাসের শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনে কেওড়া পাওয়া যায়। এই সময়ে বানরদের স্বাস্থ্য হয় দেখার মতো। কিন্তু আশ্বিনের পর যখন ফল শেষ হয়, তখন বানরেরা কচি পাতা, ঘাস, এমনকি নদীর ধারে কাঁকড়াও খেয়ে বাঁচে। তখন তাদের শরীর ঢিলেঢালা হয়ে যায়।
কেওড়া নিয়ে মজার একটি বিষয় জানায় জেলেরা। তাঁরা জানান, সুন্দরবনে বানর আর হরিণের বন্ধুত্ব চোখে পড়ার মতো। কেওড়াগাছ থেকে বানর মাঝে মাঝে পাতা ও ফল নিচে ফেলে দেয়, হরিণ সেগুলো খেয়ে পেট ভরায়। বিপদের সময়ও আবার নিচে থাকা হরিণকে বিশেষ আওয়াজ করে সতর্ক করে বানরেরা। পরে হরিণেরা পালিয়ে বাঁচে।
সোমবার কালাবগী ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, জোটবদ্ধ হয়ে ঘুরছে একদল বানর। তাদের দুষ্টুমি আর চেঁচামেচিতে মুগ্ধ তখন পর্যটকেরা। সাতক্ষীরা থেকে আসা পর্যটক আশিক আবরার বলেন, ‘এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি—হরিণের পিঠে বসে বানর ঘুরছে। বানরদের শরীর-স্বাস্থ্যও চোখে পড়ার মতো। কেওড়া ফলের মৌসুমে যতবার সুন্দরবনে এসেছি, ততবারই বানরদের এমন হৃষ্টপুষ্ট দেখেছি।’
বনকর্মী আবিদুল ইসলাম বলেন, বানরের প্রধান খাবার কেওড়া ফল। প্রকৃতির ভারসাম্যে এই ফলের অবদান অনেক। শুধু বানর নয়, হরিণ, পাখিসহ অনেক প্রাণীই কেওড়া ফল খায়। তবে বানরের স্বাস্থ্য যে ওঠানামা করে, তা কেওড়া মৌসুমে স্পষ্ট বোঝা যায়।
প্রায় ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে খাকি বানর বা রেসাস ম্যাকাক সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কালাবগী, করমজল, জামতলা, কটকা, কচিখালি, কলাগাছিয়া কিংবা হাড়বাড়িয়ার মতো ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে গেলে সহজেই দেখা মেলে তাদের দলবেঁধে খেলার দৃশ্য। বিশেষ করে কেওড়া মৌসুমে বানরের লাফালাফি, চেঁচামেচি আর ফল নিয়ে দৌড়ঝাঁপে বন যেন মুখর হয়ে ওঠে।
পর্যটন স্পটগুলোতে আসা বনকর্মী ও ট্রলারচালকেরা জানান, অনেক সময় পর্যটকেরা ট্রলার ফেলে বনে ঢুকলে, সুযোগ বুঝে বানরের দল ট্রলারে উঠে খাবারসহ নানা জিনিস নিয়ে বনের ভেতর লুকিয়ে ফেলে। হরিণ মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে পালালেও বানর উল্টো কাছে আসে। আবার পর্যটকেরা দুষ্টুমি করলে বানর ক্ষিপ্ত হয়ে কামড়ও বসায়।
অন্য সময় বানরের দল পর্যটকদের দেখলেই খাবারের জন্য ছুটে আসে এবং কেউ খাবার না দিলে আক্রমণ করে। কিন্তু কেওড়া মৌসুমে তারা পুরোপুরিভাবে কেওড়ার ফলেই মনোযোগী থাকে, পর্যটকদের খুব একটা বিরক্ত করে না।বিল্লাল হোসেন, সুন্দরবনের গাইড
দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনে গাইড হিসেবে কাজ করেন বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, অন্য সময় বানরের দল পর্যটকদের দেখলেই খাবারের জন্য ছুটে আসে এবং কেউ খাবার না দিলে আক্রমণ করে। কিন্তু কেওড়া মৌসুমে তারা পুরোপুরিভাবে কেওড়ার ফলেই মনোযোগী থাকে, পর্যটকদের খুব একটা বিরক্ত করে না।
সুন্দরবনের মুন্সিগঞ্জ টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্মল কুমার মণ্ডল বলেন, আইইউসিএনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে বানরের সংখ্যা এখন ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৪টি। ২০০৪ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৫১ হাজার। সুন্দরবনের বানরের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কেওড়া মৌসুমে তারা বিশেষভাবে সুস্থ ও মোটাতাজা হয়ে ওঠে। এই সময় ভ্রমণকারীরাও বলেন, ‘বানরের হৃষ্টপুষ্ট চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সুন্দরবনে কেওড়ার মৌসুম চলছে।’