একাত্তরের সেই স্মৃতি আজও ভোলেননি ভানু হাজরারা

ভাড়াউড়া এলাকায় চা-বাগানের শ্রমিকদের এক জায়গায় জড়ো করে গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা করা হয় অন্তত ৫০ জনকে।

১৯৭১ সালের ১ মে ৫০ চা-শ্রমিককে একসঙ্গে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। চা-শ্রমিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে রাখা হয়েছে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা–বাগানেছবি: প্রথম আলো

‘সেদিন ছিল শনিবার। সারা দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। শ্রীমঙ্গল শহরে পাঞ্জাবিরা ঘাঁটি করেছে। চা–বাগানের কাজ প্রায় বন্ধই ছিল সে সময়। সকাল ১০-১১টার দিকে আউট সিগন্যালের দিকে এসে বাগানের দক্ষিণ দিক থেকে আমাদের গ্রামের গ্রাম পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচ-ছয়জন পাঞ্জাবি বাগানে আসে। চা–বাগানের পুরুষদের সবাইকে একটি জায়গায় যেতে বলে, পাঞ্জাবিরা নাকি আমাদের চা–বাগানের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। জোর করে সবাইকে চা–বাগানের পশ্চিম দিকের একটি জায়গায় জড়ো করা হয়। শ্রমিকেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গুলি করা শুরু করে তারা।’

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ভাড়াউড়া চা–বাগানের বাসিন্দা ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ভানু হাজরা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভানু হাজরা ১৩ বছরের বালক ছিলেন। চোখের সামনে সেসব স্মৃতি ভেসে ওঠে তাঁর। ১৯৭১ সালের ১ মে পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব আজও ভুলতে পারেননি তিনি। ওই দিন হানাদারদের গুলিতে প্রাণ যায় চা-বাগান এলাকার অর্ধশত মানুষের।

ভানু হাজরা বলেন, ‘আমরা বাগান থেকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনছিলাম। একটু পর গুলির শব্দ থামলে আমরা সেখানে যাই। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, রক্তে লাল হয়ে আছে চারপাশ। একজনের ওপর একজন লাশ হয়ে পড়ে আছে। আমার বাবাও ছিলেন সেই লাশের কাতারে। আমি আর মা মিলে আমার বাবাকে লাশের ভেতর থেকে টেনে বের করি। তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। কোনোরকমে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসি। বাড়িতে নিয়ে আসার পর তিনি মারা যান। সেদিন আমার বাবাসহ অন্তত ৫০ জন চা–শ্রমিক মারা যান এই বধ্যভূমিতে। যখন এই বধ্যভূমির সামনে দিয়ে যাই, সেই দিনের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। কত রক্ত, কত লাশ চোখের সামনে পড়ে ছিল। আমরা কতটুকু অসহায় ছিলাম সেদিন।’

গতকাল মঙ্গলবার শহরের পার্শ্ববর্তী ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমিতে মারা যাওয়া চা–শ্রমিকদের স্মৃতির উদ্দেশে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়েছে। বধ্যভূমির সামনে একটি মাইলফলকে লেখা রয়েছে ১৯৭১ সালে এই স্থানে মারা যাওয়া চা–শ্রমিকদের নামগুলো।

শ্রীমঙ্গলের ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, কবি ও লেখক দীপেন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা ফিরে দেখা বইয়ে এই বধ্যভূমিতে চা–শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনীর শ্রীমঙ্গল দখল করে ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল। ওই দিন পাকিস্তান বিমানবাহিনী শ্রীমঙ্গলে শেলিং করে। ৩০ এপ্রিল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনী শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করে। ২৭ এপ্রিলের শেলিংয়ে শ্রীমঙ্গলের দুজন নিহত ও একজন আহত হন। নিহত দুজনের একজন গৌরাঙ্গ মল্লিক ও অপরজন বাসাবাড়িতে কাজ করা জনৈক এক নারী। ৩০ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলে আস্তানা করার পরদিন ১ মে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের তাণ্ডবলীলা শুরু করে। শহরের পার্শ্ববর্তী ভাড়াউড়া চা–বাগানে বহু চা–শ্রমিককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে নিহত হওয়া ফাগু হাজরার ছেলে বিজয় হাজরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিনের ঘটনার পর এখানে সব লাশ একত্র করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। সেদিনই আমরা চা–বাগান ছেড়ে পালাই। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের লোকজন এসে এখানে মাটি তুলে মাথার খুলি গণনা করে ও বধ্যভূমি চিহ্নিত করে গেছে। আমাদের চা–শ্রমিকদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের জায়গাটি একধরনের অবহেলিতই বলা যায়। এখানে যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের নাম উল্লেখ করে আমি নিজ উদ্যোগে এখানে একটি নামফলক করেছি।’