‘রানী ভবানীর রাজধানী’র সব ইউএনও নারী

নাটোরের সাত ইউএনওর দায়িত্বে আছেন সাত নারী। এর মধ্যে বাম থেকে লালপুরে শামীমা সুলতানা, বড়াইগ্রামে মারিয়াম খাতুন, সিংড়ায় মাহমুদা খাতুন, নাটোর সদরে সারমিনা সাত্তার, নলডাঙ্গায় রোজিনা আক্তার, গুরুদাসপুরে শ্রাবণী রায় ও বাগাতিপাড়ায় নীলুফা সরকার
ছবি: প্রথম আলো

নবাবি আমলে গড়ে ওঠা নাটোর রাজ্যের মহারানি ছিলেন অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী। তিনি ছিলেন নাটোর রাজবংশের উজ্জ্বলতম চরিত্র। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্যই রানী ভবানীর স্মৃতি বাংলার মানুষের কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

১৭৮৯ সালে ৭৪ বছর বয়সে রানী ভবানী রাজ্যশাসন থেকে অবসরে গিয়েছিলেন। কালক্রমে ইংরেজ কোম্পানি কালেক্টরেট নিয়োগের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আনে। একসময় জমিদারি প্রথাও বিলুপ্ত হয়। তবে স্বাধীনতা–পরবর্তী দেশের শাসনব্যবস্থায়ও নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। এর ধারাবাহিকতায় নাটোরের সব কটি উপজেলায় বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্বে আছেন নারী। রাজসিক নাটোরের এই নারী প্রশাসকদের সঙ্গে তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয়েছে প্রথম আলোর।  

হলওয়েল সাহেবের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রানী ভবানীর রাজ্য প্রদক্ষিণ করতে ৩৫ দিন সময় লাগত। দীর্ঘ ৫০ বছর সুশৃঙ্খলভাবে তিনি রাজ্য শাসন করেছেন। সেই রাজ্য অর্থাৎ বর্তমান নাটোর জেলাটি  সাত উপজেলায় বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনের প্রধান পদটি সামাল দিচ্ছেন নারী।  

নাটোর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হলেন সারমিনা সাত্তার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে তিনি বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন। সারমিনা বলেন, তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিল, তিনি একজন বড় মাপের প্রশাসক হবেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় ২০০৫ সালে তাঁর বাবা মারা যান। তখন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। পারিবারিক সিদ্ধান্তে কিছুদিনের মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রকৌশলী স্বামীর অনুপ্রেরণায় স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তবে স্নাতকোত্তর শেষ করার আগেই ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন তিনি।

রানী ভবানীকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে সারমিনা কাজ করছেন জানিয়ে বলেন, ‘রানী ভবানী খুব অল্প বয়সে এই নাটোরে বসে অর্ধবঙ্গ শাসন করে প্রজাদের মন জয় করেছেন। আমরা তাঁর পথ অনুসরণ করে নাটোরবাসীকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

২০২১ সালে বড়াইগ্রাম উপজেলার ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মোসা. মারিয়াম খাতুন। তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরি করার কারণে যেকোনো জায়গায় বদলি হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তবে পছন্দের জায়গায় যোগদানের সুযোগ পেলে আলাদা প্রশান্তি পাওয়া যায়। নাটোর আমার কাছে তেমনই একটি জায়গা। এই জেলায় এর আগেও দুই নারী জেলা প্রশাসক সুনামের সঙ্গে পূর্ণ মেয়াদে চাকরি করে গেছেন। এখানে বদলি হয়ে আসার আগে জানতে পারলাম, বিশাল নাটোর রাজ্য শাসন করে গেছেন রানী ভবানী। তাঁর সময় প্রজারা সুখে–শান্তিতে ছিলেন। এসব ইতিহাস জানার পর নিজে এখানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে খুব ভালো হয়েছে। দুই বছরেরও বেশি সময় নাটোরে থেকে নিজেকে নারী হিসেবে কখনো হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয়নি।’

রোজিনা আক্তার গত বছর নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন। যোগদানের আগেই জেনেছেন, এখানকার অন্যান্য ইউএনও নারী। তখন আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করেছে। মনে হয়েছে রাজসিক নাটোর সত্যিই নারীদের জন্য নিরাপদ একটা জায়গা। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক মাসের চাকরিতে নারী হিসেবে কোনো বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়নি। মায়ের অনুপ্রেরণায় প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলাম। এখন নারী বা পুরুষ নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয়ে অন্যের জন্য কিছু করার সুযোগ পাচ্ছি। এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা।’

জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাত ইউএনও
ছবি: প্রথম আলো

অনীলুফা সরকার নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন গত বছর। তিনি জানান, যোগদানের পর বাকি ছয় উপজেলায় নারী সহকর্মী পাওয়ায় তাঁর আত্মতৃপ্তির জায়গাটা সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন বিশেষ দিবসে তাঁরা সাত ইউএনও একই ধরনের পোশাক পরেন। এ ছাড়া কাজের ফাঁকে তাঁরা নানা বিষয় নিয়ে মন খুলে আড্ডা দেন। কিছুটা হেসে নীলুফা বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে একটু ডানপিটে ছিলাম। চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে পছন্দ করতাম। মা–বাবার পাশাপাশি আমার নিজেরও ইচ্ছা ছিল প্রশাসনে চাকরি করব। কর্মজীবনে সেটাই হয়েছে। চাকরিতে ঢোকার আগে আমাকে মাঝেমধ্যে রাজশাহী থেকে ঢাকায় দৌড়াদৌড়ি করতে হতো। একজন নারী হিসেবে ওই সময় নানা সমস্যায় পড়তাম। তবে কর্মজীবনে এসে তেমন কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি।’

জেলার লালপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা সুলতানা। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে যেকোনো কঠিন কাজকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে “নারী কর্মকর্তা” শব্দটাই একটা ইতিবাচক শক্তিশালী সম্ভাষণ মনে হয়। অর্পিত দায়িত্ব মায়া-মমতা দিয়ে পালন করার অসাধারণ সাধ্য রয়েছে নারী কর্মকর্তার।’ নিজের কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

নাটোরের পাশের জেলা পাবনার মেয়ে শ্রাবণী রায়। তিনি এখন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। পছন্দের প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পেয়ে তিনি এমনিতেই খুশি। কর্মস্থলের অন্য ছয়টি উপজেলায়ও নারী কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকায় খুশির মাত্রাটা আরও বেড়ে গেছে। কাজের অবসরে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে মন খুলে পরামর্শ করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘নাটোর একসময় অর্ধবঙ্গের রাজধানী ছিল। মহারানি রানী ভবানী এই রাজ্য শাসন করতেন। এখন এখানে সাত নারী সাত উপজেলার দায়িত্বে আছেন। সব মিলিয়ে আমার কাছে এখন পর্যন্ত এটা শ্রেষ্ঠ কর্মস্থল।’

মাহমুদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামাতে স্নাতকোত্তর করেছেন লোকপ্রশাসনে। বেশ কয়েকটি কর্মস্থল পার করে সম্প্রতি তিনি সিংড়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন। নারী হিসেবে তাঁর তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তবে এর তুলনায় আনন্দের স্মৃতি ও সফলতাই বেশি, যা তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুলিয়ে দেয়। নাটোরে আসার পর ইতিবাচক অভিজ্ঞতার পাল্লাই ভারী হচ্ছে। সরকারি সেবাগুলো জনগণের দারগোড়ায় পৌঁছানোর ব্রত নিয়ে জনবান্ধব জনপ্রশাসন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন মাহমুদা।

নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদ এককথায় বলেন, ‘অসাধারণ’। রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি মেনে জেলার সব কটি উপজেলার ইউএনওরা তাঁদের মায়া–মমতা দিয়ে স্থানীয় জনগণের মন জয় করছেন। মহারানি রানী ভবানী বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো বলতেন, ‘আমার রাজ্য ভালোই চলছে। আমার প্রজারা ভালো আছেন।’