মনভোলানো হাজারী গুড়ের খোঁজে 

ছোট ছোট পাত্রে ঢেলে রাখা হয়েছে হাজারী গুড়। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরেছবি: প্রথম আলো

কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ; সঙ্গে ঝিরিঝিরি বাতাস। তীব্র শীতের কাঁপন। ১৭ জানুয়ারি ভোর পাঁচটায় শীতের মোটা কাপড় গায়ে জড়িয়ে মোটরসাইকেলের হেডলাইট জ্বালিয়ে রওনা হলাম। মানিকগঞ্জ শহর থেকে হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকার পথ ধরে চলেছি। যানবাহনশূন্য সড়কে সামান্য দূরের পথও দেখা যায় না। এরই মধ্যে এগিয়ে চলেছি ধীরগতিতে। প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গোপীনাথপুর উত্তর পাড়ায় যখন পৌঁছালাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় ভোর পৌনে ছয়টা। তখনো চারপাশ কুয়াশাচ্ছন্ন। সড়কের পাশে সারি সারি খেজুরগাছে মাটির হাঁড়ি ঝুলছে। গাছিদের কেউ কেউ রসভর্তি হাঁড়ি নামাচ্ছেন।

রস সংগ্রহকারী রজ্জব আলীর পেছনে ছুটলাম। উদ্দেশ্য—সেই বিখ্যাত হাজারী গুড়ের খোঁজ পাওয়া। তিনি নিয়ে গেলেন গাছি মোজাফ্ফর হোসেনের বাড়িতে। সারা বাড়িতে কাঁচা রসের মিষ্টি ঘ্রাণ। কিছুক্ষণের মধ্যে মাটির জ্বলন্ত চুলার (গাছিদের ভাষায় বায়িং) ওপর বসানো তাফালে রস ঢালা হলো। একজন চুলা জ্বাল দিচ্ছেন, দুজন পাত্রের রস নাড়ছেন। এই কর্মযজ্ঞ চলল ২০ থেকে ২৫ মিনিট। পাত্রে জ্বাল দেওয়া রসের ঘনত্ব কিছুটা বেড়ে হালকা খয়েরি রং ধারণ করল। সঙ্গে সঙ্গে সেই রস মাটির পাত্রে ঢালা হলো। এরপর মোজাফ্ফর ও তাঁর সহকারী বাঁশের কাঠি (নাড়ানি) দিয়ে জোরে নাড়তে থাকলেন সেই জ্বাল হওয়া রস। যত সময় যায়, রসের ঘনত্ব বাড়তে থাকে এবং কিছুটা সাদা (অফহোয়াইট) হতে থাকে।

এভাবে ১০ থেকে ১৫ মিনিট নাড়ার পর মোজাফ্ফর তা ঘরের মেঝেতে রাখা ছোট ছোট পাত্রে ঢাললেন। এরপর বিশেষ এই গুড়ে হাজারী সিল বসানো হলো। এভাবেই তৈরি হলো এ দেশের ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়।

শীত এলে এ দেশের গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পিঠা-পায়েস তৈরির আয়োজন শুরু হয়। এ সময়ে খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা এমনিতেই বেশি। আর হাজারী গুড় হলে তো কথাই নেই! যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য বহন করে আসছে মানিকগঞ্জের এই হাজারী গুড়। মনভোলানো স্বাদের পাশাপাশি এই গুড়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, হাতে নিয়ে চাপ দিতেই গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যায়।

হাজারী গুড় তৈরির কারিগরদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, শুধু দেশেই নয়, এই গুড়ের সুনাম ছড়িয়ে আছে দেশের বাইরেও। কথিত আছে, ব্রিটিশ শাসনামলে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ ভারতে আসেন। সে সময় উপহার হিসেবে রানির কাছে পাঠানো হয় এই হাজারী গুড়। এই গুড় খেয়ে রানি ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।

এই গুড়ের নামেই জেলার ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে, ‘হাজারী গুড় আর বাউলগান, মানিকগঞ্জের আসল প্রাণ।’

হরিরামপুরের ঝিটকা শিকদারপাড়ার (গাছিপাড়া) রহিজ উদ্দিন হাজারীর (৬০) পূর্বপুরুষ ছিলেন হাজারী প্রামাণিক। রহিজ উদ্দিন হাজারী জানালেন, প্রায় ৩৫০ বছর আগে ঝিটকা শিকদারপাড়ার হাজারী প্রামাণিক খেজুরগাছ থেকে মাটির হাঁড়িভর্তি রস পেড়ে বাড়িতে ফিরছিলেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত এক দরবেশ তাঁর হাঁড়ির রস পান করে আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলেন, ‘এই রসের গুড়ের সুনাম একদিন সবখানে ছড়িয়ে পড়বে।’ এরপর যত দিন যায়, এ রসের গুড়ের স্বাদ ও মান বাড়তে থাকে। এই গুড়ের নাম হাজারী গুড় নামে পরিচিতি পেতে থাকে।

রহিজ হাজারী বলেন, একটা সময় শতাধিক পরিবার এই গুড় তৈরির কাজ করত। তবে এখন ২০ থেকে ২৫টি হাজারী পরিবার বংশপরম্পরায় যুক্ত রয়েছে এই গুড় উৎপাদনের সঙ্গে। মোজাফফর হোসেন তাঁদের একজন।

বানানো হচ্ছে হাজারী গুড়
ছবি: প্রথম আলো

মোজাফ্ফর বলছিলেন, তীব্র শীতে স্বচ্ছ রসে হাজারী গুড়ের মান ও স্বাদ ভালো হয়ে থাকে। ১০ থেকে ১২ কেজি রসে এক কেজি হাজারী গুড় হয়। প্রতি কেজি গুড় ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ গুড়ের চাহিদা বেশ। তবে খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় রস সংগ্রহ ও হাজারী গুড় উৎপাদন কমে গেছে। এ ছাড়া রয়েছে জ্বালানির সংকটও।

এই প্রতিবেদক এক কেজি গুড় কিনতে চাইলে দিতে পারলেন না মোজাফফর হোসেন। কারণ, সব গুড় আগেই বিক্রি করা।

ঐতিহ্যবাহী এই হাজারী গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে এবং গুণগত মান বজায় রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার বললেন, ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড় শুধু মানিকগঞ্জের হরিরামপুরেই তৈরি হয়। এ গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে উপজেলায় পাঁচ লাখ খেজুরগাছ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক খেজুরগাছ রোপণ করা হয়েছে। এ গুড়ের গুণগত মান বজায় রাখতে কারিগরদের প্রশিক্ষণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রতিশ্রুতি, এসব কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে হরিরামপুরে গড়ে তোলা হবে ‘হাজারী গুড়পল্লি’।