বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দিতে টাইমার হিসেবে ব্যবহার করেছেন মশার কয়েল

বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমানপ্রথম আলো

পেশায় চিকিৎসক হলেও নেশায় পুরোদস্তুর মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মাহফুজুর রহমান। একাত্তরে রণাঙ্গনের সম্মুখসমরের এই যোদ্ধা স্বপ্ন দেখেন অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার। সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণা করেন চট্টগ্রামের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আজীবন সংগ্রামী মাহফুজুর রহমানের (৭৪) মননে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন হয়েছিল সেই কৈশোরে। ১৯৬৪ সাল, তিনি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতিতে। তখন ছাত্রলীগ নেতাদের পেছনে স্লোগান ধরতেন। এরপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে তাঁকে আর আলাদা করা যায়নি। নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারির একজন হয়ে ওঠেন মাহফুজুর রহমান। এরপর ছয় দফা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে এক দফার স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মাহফুজুর রহমান ছিলেন সক্রিয়। তখন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজর ছাত্র। ভারতে দুই দফা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের শুরুতে আন্দরকিল্লার একটি অস্ত্রের দোকান থেকে অস্ত্র লুট করে নিয়ে আসেন। তখন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র। জড়িয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে।
মাহফুজ বলেন,  তখন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের দুটি ধারা ছিল। একটি শহর আওয়ামী লীগ, অপরটি জেলা আওয়ামী লীগ। মাহফুজুর রহমান ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগে। সেখানে মৌলভি সৈয়দের মতো নেতারা দায়িত্ব পালন করছিলেন। শহর আওয়ামী লীগে ছিলেন জহুর উদ্দিন আহমেদ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীরা। শহর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ছিল বর্তমানে পর্যটন মোটেল সৈকতে। জেলা আওয়ামী লীগ ১২০ আন্দরকিল্লায় নিজেদের কার্যালয় গড়ে তোলে। ২৫ মার্চ রাতে এই দুই কার্যালয়ই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করার দায়িত্ব নিয়েছিল।

মাহফুজুর রহমান স্মৃতিচারণা করে বলেন, রাতে সংগ্রাম পরিষদের কাছে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার নির্দেশ আসে, ফোনে। তখন সৈকত হোটেল ও আন্দরকিল্লা থেকে মাইকিং শুরু হয়। ওই দিনই ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধরা হালিশহরে ইপিআর ক্যাম্প দখল করে নিয়ন্ত্রণ নেন। ২৬ মার্চ সকালে ছলিমপুর ওয়‍্যারলেস স্টেশনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এসে পৌঁছায়। এরপর স্বাধীনতার ঘোষণা হলো। এখন সম্মুখসমরের পালা।
যুদ্ধে অংশ নিতে মাহফুজুর রহমান যোগ দেন ফ্রিডম ফাইটার গ্রুপ-৬-এ। দলটির কমান্ডার হন তিনি। এপ্রিলের শুরুতে আরও অনেকের সঙ্গে মাহফুজুর রহমান ভারতের ত্রিপুরা চলে যান প্রশিক্ষণের জন্য। সাত দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা পাঁচজনের একটি দল দেশে ফিরে আসার সময় সীতাকুণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনী ও দেশি সেনাসদস্যদের মধ্যে যুদ্ধের মধ্যে পড়েন। পরে তাঁরা শুভপুর এলাকায় সেনাসদস্যদের ক্যাম্পে ছিলেন কয়েক দিন। সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্রসহ রামগড়ে চলে যান।

মাহফুজুর রহমান বলেন, 'রামগড়ে ১ বা ২ মে প্রথম অস্ত্র চালনার মাধ্যমে  আমরা প্রথম যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। কিন্তু তখনো আমরা অস্ত্র চালনায় অতটা পারদর্শী নই। এরপর আবার প্রশিক্ষণে চলে যান মাহফুজুর রহমান। এবার উত্তর প্রদেশের তান্দোয়াতে। আগরতলা থেকে বিমানে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে দেড় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে মাহফুজুর রহমান ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। এরপর তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়ে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেওয়ার। ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন, মৌলভি সৈয়দেরা তখন যৌথ বাহিনীর নেতা। আর মাহফুজুর রহমান কমান্ডার।
ফয়’স লেক এলাকায় একটা বড় বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দিয়েছিলেন মাহফুজুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা। বড় অভিযান করলেও তেমন কোনো সরঞ্জাম ছিল না তাঁদের। তিনি বলেন, 'সেপ্টেম্বরের কোনো এক রাতে আমরা বিস্ফোরক নিয়ে সেখানে যাই। আবদুল্লাহ আল হারুন ভাইও ছিলেন। কিন্তু বিস্ফোরণের জন্য টাইমার ছিল না। মশার কয়েলকে টাইমার হিসেবে সেট করেছিলাম আমরা। কয়েল জ্বলতে জ্বলতে শেষ মাথায় এসে আগুন ধরে যাবে। হলোও ঠিক তাই।’

সফল অপারেশন শেষে ফিরে আসার সময় ফজরের নামাজের সময় হয়। তখন মুসল্লিরা প্রথমে আমাদের হানাদার বাহিনী মনে করে। পরে আমি যেহেতু ওই প্রতি এলাকায় থাকতাম, আমাকে চিনতে পারে। এরপর তারা আমাদের পাহারা দিয়ে এলাকা পার করে দেয়। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে একযোগে শহরের ১০০ স্থানে বিস্ফোরণেও আংশ নেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ-নিউক্লিয়াসের সদস্য মাহফুজুর রহমান। তবে ১৫ স্থানে তখন বিস্ফোরণ সফল হয়নি।

নভেম্বরে চট্টগ্রাম শহরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্রে মাহফুজুর রহমানসহ অন্যদের ওপর অস্ত্র চালনা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তখন নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে করা নিয়েছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে আশ্রয় নিয়েছিলেন বিভিন্ন জায়গায় মানুষের ঘরে। সে সময়ের সহযোগিতার কথা তিনি আজও ভোলেন না।