সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরীগাছ পরগাছার আক্রমণে বিপন্ন

পরগাছায় ঢেকে থাকা সুন্দরবনের সুন্দরীগাছ। সুন্দরবনের কালাবগী এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের বনজীবী জাহিদুল ইসলাম। ৩০ বছর ধরে সুন্দরবন ঘিরে জীবিকা তাঁর। সম্প্রতি সুন্দরবনের একটি পরিবর্তন তাঁর চোখে পড়েছে। সেটি হলো—পাঁচ-ছয় বছর আগেও যেখানে সুন্দরীগাছের ঘন জঙ্গল ছিল, এখন সেসব জায়গা প্রায় ফাঁকা। বহু সুন্দরীগাছ শুকিয়ে গেছে।

সুন্দরীগাছ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পেল পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সাম্প্রতিক এক ফেসবুক পোস্টেও। তিনি লিখেছেন, ‘সুন্দরবনের বয়স্ক সুন্দরীগাছে তিন ধরনের পরগাছা গাছগুলোকে মেরে ফেলছে। এর প্রতিকারের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, তা দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণ আমাদের পরামর্শ দিতে পারেন।’

বনজীবী ও বন কর্মকর্তার কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সুন্দরবনে সুন্দরীগাছ বিপদে পড়েছে। এই বিপদের নাম ‘পরগাছা’। এই নীরব পরজীবী সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরীগাছকে ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ করছে। আগে শাখা-প্রশাখায় সীমাবদ্ধ থাকা পরগাছা এখন মূল অংশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। গাছ দুর্বল হয়ে একসময় শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। তবে এই পরগাছা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। ফলে কীভাবে এর মোকাবিলা করে সুন্দরীগাছ বাঁচানো যাবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।

গহিন বনে একের পর এক রোগাক্রান্ত গাছ

বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে যান সুন্দরবনের শিবসা নদীসংলগ্ন কালাবগী এলাকার গহিন অরণ্যে। যত ভেতরে যাচ্ছিলেন, চোখে পড়ছিল একের পর এক রোগাক্রান্ত গাছ। কিছু শুকিয়ে মরা, কিছু আগা মরায় কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ সুন্দরীগাছের গায়ে দেখা গেল ধূসর-বিবর্ণ কিংবা গাঢ় সবুজ রঙের নানা ধরনের পরগাছা। কারও গায়ে যেন শেওলার চাদর, কারও ডালে ঘন লতাপাতার আস্তরণ।

গত বছরও একই জায়গায় গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। তখন এমন পরগাছার ছড়াছড়ি ছিল না। সফরসঙ্গীদের মধ্যে যাঁরা বহুবার সুন্দরবনের এই অঞ্চলে গেছেন, তাঁরাও বললেন, কয়েক বছর আগেও এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি। কয়রায় ফিরে তিনি কথা বলেন প্রবীণ-নবীন মিলে ১০ জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালের সঙ্গে। প্রত্যেকেই বললেন, এখন সুন্দরবনের গাছে পরগাছা অনেক বেড়েছে। আগে এতটা দেখা যেত না। বয়স্ক ও সুন্দরী প্রজাতির গাছই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।

সুন্দরবনের কোনো কোনো গাছে যেন শেওলার চাদর। সুন্দরবনের কালাবগী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরীগাছের ২৫–৩০ শতাংশ পরগাছার কবলে

সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সুন্দরীগাছ আছে। সুন্দরীগাছে পরগাছা নিয়ে কথা হয় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের ডিএফও মো. রেজাউল করীম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, সুন্দরীগাছে আগে থেকেই টপ ডাইং বা আগামরা রোগের প্রাদুর্ভাব আছে। এর সঙ্গে নতুন করে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে পরগাছা। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সুন্দরীগাছ পরগাছায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। অনেক গাছ মরে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর ভাষায়, ‘এই পরগাছা এখন সুন্দরবনের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। সুন্দরীগাছ রক্ষায় দ্রুত এই পরজীবী উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।’

পরগাছার ছবি মুঠোফোনে ধারণ করে পাঠানো হয় বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মমিনুল ইসলামের কাছে। তিনি জানান, সুন্দরবনে কোন কোন ভেষজ, গুল্ম, লতা, ফার্ন ও গাছের প্রজাতি পাওয়া যায়, তা তাঁরা শনাক্ত করেছেন। তবে পরগাছা নিয়ে এখনো বিস্তারিত গবেষণা বা বিশ্লেষণমূলক কাজ করা হয়নি।

সুন্দরীগাছে আগে থেকেই আগামরা রোগের প্রাদুর্ভাব আছে। এর সঙ্গে নতুন করে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে পরগাছা। সুন্দরবনের কালাবগী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পরগাছার একই ছবি পাঠানো হয়েছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ওয়াসিউল ইসলামের কাছে। তিনি ছবিগুলো দেখে বলেন, এখানে দুই ধরনের উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে। একটি হলো ‘মিসলটো’ নামে পরিচিত একধরনের পরগাছা। এটি পোষক গাছের গায়ে জন্মে তার থেকেই পুষ্টি সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলন ও বীজ দুর্বল হয়ে পড়ে। আর অনেক সময় গাছটি শুকিয়ে যায় বা মারা যায়। আরেকটি একধরনের ফার্ন, যা পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ। এটি গাছের পুষ্টি শোষণ করে না, শুধু আশ্রয় নেয়।

সুন্দরীগাছে পরগাছা কেন বেশি হয়

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, সুন্দরীগাছে পরগাছা বেশি দেখা যাচ্ছে, কারণ এগুলো তুলনামূলক দুর্বল। যেখানে লবণাক্ততা বেশি, কিংবা জোয়ার-ভাটার পানি চলাচল কম; এমন প্রতিকূল পরিবেশে গাছগুলো সহজেই আক্রান্ত হয়। যেসব সুন্দরীগাছ ইতিমধ্যে আগামরা রোগে আক্রান্ত, তাদের দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়েই পরগাছা ছড়িয়ে পড়ছে। সাধারণত শীত মৌসুমে এসব পরগাছা ফুল ও ফল দেয়। তার আগে সরিয়ে ফেলতে পারলে বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব। পাখিরা এদের বীজ এক গাছ থেকে আরেক গাছে ছড়িয়ে দেয়।

অধ্যাপক ওয়াসিউল ইসলাম সতর্ক করেন, লবণাক্ততার প্রভাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুন্দরীসহ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ কমে গেলে পুরো সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

লবণাক্ততার প্রসঙ্গ এসেছে সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবিরের কথাতেও। তিনি বলেন, ফারাক্কা বাঁধের পর সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গাছ পানি ওপরে তুলতে পারছে না। ফলে গাছ ছোট হচ্ছে। আগামরা দেখা দিচ্ছে। দুর্বল গাছে পরগাছা জন্ম নিয়ে দ্রুত গাছের মৃত্যু ঘটাচ্ছে। তাঁর মতে, সমস্যার মূল কারণ পরগাছা নয়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি। উজানের নদীগুলো দিয়ে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে পারলে বন পুনরুজ্জীবিত হবে।

সুন্দরীগাছ বাঁচাতে করণীয় কী

উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম মনে করেন, উজান থেকে পশুর ও বলেশ্বর নদের মাধ্যমে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানো একমাত্র কার্যকর পদক্ষেপ। সময় নষ্ট করলে সুন্দরীগাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুন্দরবনভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’তে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইআইএসইআর) কলকাতার অধ্যাপক পুণ্যশ্লোক ভাদুড়ী লিখেছেন, সুন্দরবনের দূষণ শুধু প্লাস্টিক বা শিল্পবর্জ্যে নয়। নদীর পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জিন ক্রমেই বাড়ছে, যা ‘সুপারবাগ’ তৈরি করছে। দুই দেশের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণার মাধ্যমে জিনোম ম্যাপ তৈরি করলে বোঝা যাবে কোন জীবাণু কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে ছড়াচ্ছে এবং রোধের উপায় কী।

সুন্দরীগাছ তুলনামূলক দুর্বল। ফলে পরগাছাও বেশি আক্রমণ করে তাদের। সুন্দরবনের কালাবগী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

একই ম্যাগাজিনে আরেকটি প্রবন্ধে ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সৌমেন ভট্টাচার্য লিখেছেন, বর্তমান সময়ে ‘সুপারবাগ’ বা একধরনের জীবাণু শুধু মানুষের শরীরেই নয়, পুরো বাস্তুতন্ত্রের জন্যই এক বড় হুমকি।

সুন্দরবনের প্রাণী ও গাছে থাকা ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হলে তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। আধুনিক জিনোম বিশ্লেষণ ও গবেষণার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। এতে মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি একসঙ্গে ‘সুপারবাগ’-এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে।